|
|
|
|
ধৃতদের হেফাজতে না নেওয়ায় বিতর্ক
দেবাশিস ভট্টাচার্য • দার্জিলিং |
লাভপুরে গণধর্ষণ মামলায় অভিযুক্তদের পুলিশ নিজের হেফাজতে নিতে না-চাওয়ায় ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশাসনিক সূত্রের মতে, পুলিশের এই অবস্থানের ফলে ঘটনার তদন্তে তাদের তৎপরতার অভাব আছে এমন বার্তা যাবে বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই তাঁর নির্দেশে বৃহস্পতিবারই জেলার পুলিশ সুপার এস সি সুধাকরকে শো-কজ করে রাতারাতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ভর্ৎসনার মুখে পড়েছেন রাজ্য পুলিশের শীর্ষ কর্তাও।
বুধবার রাতে গণধর্ষণের অভিযোগ পেয়ে বীরভূমের পুলিশ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে। এ দিন বোলপুর আদালতে তোলা হয় তাদের। পুলিশ অভিযুক্তদের হেফাজতে নেওয়ার আর্জি না-করায় এসিজেএম পীযূষ ঘোষ প্রত্যেককেই ১৪ দিন জেল হেফাজতের নির্দেশ দেন। কেন পুলিশ অভিযুক্তদের নিজের হেফাজতে চাইল না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খোদ পুলিশের একাংশও স্বীকার করছেন, হেফাজতে নিতে না-চাওয়ার অর্থ, অভিযুক্তদের আর জেরা করার দরকার নেই। সাধারণ ভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রেই এমন করা হয়। গণধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায়, যেখানে গোটা বিষয় সম্পর্কে ধোঁয়াশা পুরো কাটেনি, সেখানে অভিযুক্তদের পুলিশি হেফাজত না-চাওয়াটাই মমতার ক্ষোভের কারণ। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, ‘মেয়েটির অভিযোগ নিয়ে বিস্তারিত তদন্তের পরেই ঘটনার সত্যতা জানা যাবে। কিন্তু এই ধরনের অভিযোগে যারা ধৃত, তাদের কেন পুলিশ হেফাজতে চাইলেন না সরকারি আইনজীবী? কেন জেল হেফাজতের বিরোধিতা করলেন না?’
প্রশাসনিক সূত্রে বলা হচ্ছে, পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি, মধ্যমগ্রাম নতুন জমানায় ধর্ষণ সংক্রান্ত পরপর ঘটনা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেটা আর বাড়তে দিতে চাইছেন না। বরং তদন্তে কোনও রকম গাফিলতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে প্রশাসনের তরফে কঠোর বার্তা দিতেই চাইছেন তিনি। কিন্তু লাভপুরের ঘটনা নিয়ে এ দিন আদালতে পুলিশের ভূমিকা সেই চেষ্টাকে ধাক্কা দিয়ে সরকারকে অস্বস্তির মুখে ফেলে দিয়েছে বলে স্বীকার করছেন নবান্নের একাধিক কর্তা। আর এতেই চটেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাতেই জরুরি ভিত্তিতে এসপি-কে সরিয়ে দেওয়া হল।
প্রশাসন সূত্রে খবর, জেলার নতুন এসপি হতে পারেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত এসপি (শিল্পাঞ্চল) অলোক রাজোরিয়া। প্রথমে উঠেছিল দার্জিলিংয়ের এসপি কুণাল অগ্রবালের নাম। একই জেলায় চার বছর থাকায় তাঁর বদলি হওয়ারই কথা। এমনিতে ঠিক ছিল, তিনি এর পর জলপাইগুড়ির এসপি হবেন। কিন্তু এ দিনের ঘটনার পরে তড়িঘড়ি তাঁকেই বীরভূমে পাঠানোর কথা হয়। পরে আবার ঠিক হয়, তাঁকে বদলি করা হবে জলপাইগুড়িতেই। দার্জিলিঙে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন উত্তর দিনাজপুরের এসপি অখিলেশ চতুর্বেদী। বীরভূমে যাবেন অলোক রাজোরিয়া। নতুন এসপি পদে যোগ দেওয়ার আগেই আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্তকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এ দিন সুধাকর পদ থেকে সরে গিয়েছেন।
শুধু সুধাকর নন, পুলিশের ভূমিকায় মুখ্যমন্ত্রীর রোষের মুখে পড়েন রাজ্যের পুলিশ প্রধান (ডিজি) জিএমপি রেড্ডি-ও। এ দিন তিন দিনের সফর শেষ করে দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি ফেরার পথে খবরটা শোনেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর ডিজি থেকে এসপি পর্যন্ত সকলকে ফোন করে সব কিছু জেনে নেন। তার পরেই তিনি ডিজি থেকে শুরু করে জেলা পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের তিরস্কার করেন। মুখ্যমন্ত্রীর মতোই একই সুরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, বোলপুরের সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোমও। হাসপাতালে নির্যাতিতাকে দেখতে গিয়ে তিনি বলেন, “ভয়ঙ্কর ঘটনা। অনেক কিছুই এখনও জানা বাকি। অথচ অপরাধীদের নিজেদের হেফাজতে নিল না পুলিশ!”
কেন এমন করল পুলিশ? জেলা পুলিশ অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকে তাদের তরফে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেটি হল: অভিযুক্তেরা জেল হেফাজতে থাকলে শনাক্তকরণে (টিআই প্যারেড) সুবিধা হয়। বিচারের কাজও দ্রুত এগোয়। তাই আদালতে দাঁড়িয়ে সরকার পক্ষের আইনজীবী জেল হেফাজতের বিরোধিতা করেননি। বীরভূমের অপসারিত পুলিশ সুপার
সুধাকরের বক্তব্য ছিল, “সব অভিযুক্তই যখন ধরা পড়েছে, তখন তাদের আর পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে, গোটা বিষয়টি নজরে রাখা হয়েছে।”
কিন্তু ব্যাখ্যাটি মুখ্যমন্ত্রী গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেননি। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি জানিয়েছেন, আইন আইনের পথেই চলবে। কিন্তু ধর্ষণের মতো স্পশর্কাতর ঘটনায় মানুষ সরকারের সদর্থক ভূমিকা ও কঠোর মনোভাব দেখতে চান। কিন্তু লাভপুর নিয়ে এ দিন পুলিশের ভূমিকায় মানুষের কাছে উল্টো বার্তাই যেতে পারে বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই যে কোনও ভাবে ধৃতদের পুলিশ হেফাজতে এনে তদন্ত চালানোর ব্যবস্থা করতে জেলা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কী করে তা সম্ভব, তার পথও বাতলেছেন। জেলা প্রশাসনকে বলেছেন, অবিলম্বে ওই মেয়েটির একটি জবানবন্দি নিন। তার ভিত্তিতে নতুন করে মামলা সাজিয়ে ধৃতদের পুলিশ হেফাজত চেয়ে আদালতে আবেদন করুন। প্রশাসনিক সূত্রের দাবি, মুখ্যমন্ত্রী সর্বতো ভাবে বোঝাতে চান এই ধরনের ঘটনায় সরকার কোনও ভাবেই শিথিলতা দেখাচ্ছে না।
বিরোধীদের দাবি, এর পিছনে রাজনৈতিক অঙ্ক রয়েছে। লাভপুরের ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরে ব্যাপক প্রচার শুরু হয়েছে। জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সনও এই নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। লোকসভা ভোটের আগে এটা রাজ্য প্রশাসনের পক্ষে সুখকর নয়। সেই কারণেই এসপি-কে বদলি করে সরকার নিজের তৎপরতা প্রমাণ করতে চাইছে। |
সহ প্রতিবেদন: মহেন্দ্র জেনা। |
|
|
|
|
|