বীরভূমের লাভপুরে যে ঘটনাটি ঘটিয়া গেল, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে একটিই প্রতিক্রিয়া সম্ভব: তীব্র আত্মধিক্কার। যে দেশে এই একবিংশ শতকে এমন সামূহিক ভিত্তিতে পাশবিকতা ঘটিতে পারে, যেখানে বিচারের নামে এই কদর্যতম নারী-নির্যাতন চলিতে পারে, গ্রামের সকলে মিলিয়া সেই নির্যাতন উপভোগ করিতে পারে, সেই দেশের নাগরিক বলিয়া পরিচয় দিতে গিয়া আত্মধিক্কার ছাড়া আর কোনও অনুভূতি হয় না। আধুনিক ভারতের লজ্জা হইয়া রহিল এই ঘটনা। উদ্ধৃতিযোগ্য হইয়া থাকিল সালিশি বিচারের রায় যে গোষ্ঠীর সম্মানভঙ্গের অপরাধে মেয়েটির শাস্তি, সকলে উহাকে লইয়া ‘মস্তি’ করিয়া লউক। পাকিস্তান, কিংবা পশ্চিম এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশ বিষয়ে যেমন এই ধরনের ঘটনা বিশ্বময় বহুল প্রচলিত ও আলোচিত, পশ্চিমবঙ্গও অতঃপর সেই গোত্রে নাম লিখাইতে পারিল, অভিনন্দন। পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম খাপ পঞ্চায়েতের সৌজন্যে এই নব-পালক দেশের মাথায় যুক্ত হইল, মনে রাখিতে হইবে।
ভারতীয় সমাজের সর্ব স্তরে, শহরে গ্রামে মফসসলে সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা যে কত স্বল্প, প্রত্যহ তাহার দৃষ্টান্ত মিলিতেছে। কিন্তু তাহার মধ্যেও লাভপুরের দৃষ্টান্তটি পৃথক, একক। কেননা, এখানে কোনও দুষ্কৃতী কিংবা বিপথগামী তরুণের দ্বারা এই গণধর্ষণ সংঘটিত হয় নাই, বিচারের নামে, সমাজের নামে, প্রশাসনের নামে, সর্বোপরি সভ্যতার নামে এই চূড়ান্ত অনাচারটি ঘটিয়াছে। যতই গ্রামের সালিশি সভার বিচার হউক, আধুনিক ভারতে যেহেতু সেই বিচারের এক প্রকার মান্যতা রহিয়াছে, পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পরিধির মধ্যে তাহার অন্তর্ভুক্তি রহিয়াছে, তাহা মনে রাখিতে হইবে। সেই দিক হইতে ঘটনাটি একটি বিক্ষিপ্ত বিষয় নহে, অত্যন্ত উদ্বেগজনক প্রশ্ন। অপরাধ যাহাই হউক, যতটুকুই হউক, তাহার বিচার কেন গণতান্ত্রিক দেশের সাংবিধানিক বিচারব্যবস্থার বাহিরে হইবে। কেন কোনও গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বা সমাজের অভ্যন্তরীণ বিচারের আদৌ এই মান্যতা থাকিবে। প্রশ্নটি গুরুতর, কারণ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর ভিতর তাহার নিজস্ব মূল্যবোধ ও অভ্যন্তরীণ উচ্চাবচতা, বর্ণ-লিঙ্গ-জাতের অসাম্য থাকিবার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। জাত-কেন্দ্রিক এমন অপরাধ ও তুলনীয় শাস্তিদানের কথা বহু বার শোনা গিয়াছে। এই উচ্চাবচতা ভাঙাই ভারতীয় সংবিধানের একটি মৌলিক লক্ষ্য। সেই সংবিধান গ্রামসমাজকে তাহার ভিত্তি হিসাবে স্বীকার করে নাই, ব্যক্তির স্বাধীন জীবনকেই ধ্রুবতারার আসনে বসাইয়াছে। সে জন্য গণপরিষদে কৌম অধিকার বনাম ব্যক্তির অধিকারের তীব্র টানাপড়েন চলিয়াছে। গ্রামসমাজের গাঁধীবাদী আদর্শের বিপ্রতীপে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রবক্তাদের পক্ষে সেই লড়াই সহজ ছিল না। আজ, চৌষট্টি বছর বয়সী প্রজাতন্ত্রে সেই মূল নীতির বাহিরে বিচরণ করিতে তৎপর কোনও মূল্যবোধ বা বিচার-কাঠামো তিলমাত্র স্বীকৃতি পাইবে কেন?
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতির মধ্যে সামাজিক অবস্থানের এই আপেক্ষিক উচ্চাবচতা সর্বদাই একটি অস্বস্তির খোঁচা হইয়া থাকিয়াছে। লাভপুরের ঘটনা বলিয়া দেয়, ইহা কেবল একটি তাত্ত্বিক খোঁচা নহে, অত্যন্ত বাস্তব, রক্তমাংসের উদ্বেগ। ‘মস্তি’-লোলুপ সমাজের নৃশংসতার সামনে ব্যক্তিমানুষের অসহায়তার প্রাত্যহিক সংকট। কী ভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং নাগরিক মৌলিক অধিকারের যুগপৎ প্রতিষ্ঠা সম্ভব, আধুনিক দেশকে তাহার মীমাংসা করিতে হইবে। বৃহত্তর ভারতের প্রতিটি অণু-সমাজে সুস্থ-নিরাপদ জীবনের অধিকার-রক্ষার জন্যই কাজটি অতীব জরুরি। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনের কর্তব্য: পত্রপাঠ সংশ্লিষ্ট গ্রামের মোড়ল-সহ প্রতিটি অপরাধীকে কঠোর শাস্তিদান। |