শিকড়হীন নই, ঘরে ফিরে বললেন ঝুম্পা
ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।
রে ফিরলেন ঝুম্পা লাহিড়ী। ফিরলেন তাঁর স্মৃতির শহরে, স্মৃতির ভাষায়। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁর নতুন উপন্যাস ‘দ্য লোল্যান্ড’-এর বাংলা অনুবাদ ‘নাবাল জমি’ (আনন্দ)-র প্রকাশ। লন্ডনে জন্মানো, আমেরিকায় বেড়ে-ওঠা কন্যা সেই অনুষ্ঠানে টালিগঞ্জে ঠাকুমার বাড়ি, বিবেকানন্দ রোডে মামার বাড়ির কথা জানালেন পরিষ্কার বাংলায়। ‘দ্য লোল্যান্ড’-এর অন্যতম নায়ক, নকশালপন্থী সুভাষকে যেখানে মা-বাবার চোখের সামনে গুলি করে পুলিশ? “ঘটনাটা শুনেছিলাম। কিন্তু লেখার সময় বারবার কান্না পেয়েছে,” বলতে বলতে গলা বুজে এল তাঁর।
মঞ্চের অদূরে ঝুম্পার মা ও বাবা। একটু আগেই পরিচিত এক জনকে ঝুম্পার মা বলছিলেন, “মেয়েকে ও-ভাবেই বড় করেছি। বলা ছিল, বাড়িতে বাংলা বলতে হবে।” কলকাতার ট্যাঁশ বাঙালি যখন বাংলায় কথা বলতে লজ্জা বোধ করে, সেই সময় ঝুম্পা দেখিয়ে গেলেন, মার্কিন মুলুকে রোড আইল্যান্ডের বাড়িতে কী ভাবে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে বাঙালি ঘরানাতেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন নীলাঞ্জনা সুদেষ্ণা লাহিড়ী। তিনিই তো নিজের ডাক নামটিকে স্বেচ্ছায় পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে হয়েছেন ঝুম্পা লাহিড়ী!
কলকাতায় সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলন আর আমেরিকায় রোড আইল্যান্ড মিশে গিয়েছে ঝুম্পার ‘দ্য লোল্যান্ড’ উপন্যাসে। ইতালীয় স্বামী আলবার্তো, ছেলে অক্টাভিও এবং মেয়ে নুরকে নিয়ে এই সপ্তাহের শুরুতেই যোগ দিয়েছিলেন জয়পুর সাহিত্য উৎসবে। সেখানেও ‘দ্য লোল্যান্ড’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। আপনার উপন্যাসে কি বাস্তব এবং কাল্পনিক দু’টো কলকাতা? দুনিয়ার যে কোনও সাহিত্য উৎসবে এখন ঝুম্পা লাহিড়ী মানেই অবধারিত কলকাতা নিয়ে প্রশ্ন। কারণ ‘দ্য লোল্যান্ড’-এর সুভাষ, উদয়ন। ‘দ্য নেমসেক’-এর অসীমা, কিংবা ‘ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিজ’-এর বিবি হালদার। জয়পুরের সর্বভারতীয় দর্শক, দেশি-বিদেশি মিডিয়ার উপস্থিতিতে ঝুম্পা সে দিন জানিয়েছিলেন, কলকাতা তাঁর জীবনে অনুপস্থিত, তবু ভয়ঙ্কর ভাবেই উপস্থিত! আমেরিকার বাড়িতে মা-বাবাকে বলতে শুনতেন, কলকাতাই তাঁদের দেশ। আবার কলকাতায় আত্মীয়স্বজনরাও ভাবতেন, ওঁরা শুধুই আমেরিকা-প্রবাসী। সে দিন ছিল অনাবাসীর শিকড়হীনতার কথা। আর সপ্তাহ না ঘুরতেই মা-বাবার শহরে এসে জানিয়ে গেলেন, সব শিকড় হারায়নি। কিছু আজও টিকে আছে বাংলা ভাষায়। তাঁর মা-বাবার ভাষায়, ঘরের ভাষায়। “আপনার ছেলেমেয়েরা হাত দিয়ে মেখে ভাত খেতে পারে?” জয়পুরে প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলেছিলেন ঝুম্পা, “না, ওরা পারে না। কিন্তু আমি হাত দিয়ে খেতে পারি, মাছের কাঁটাও বাছতে পারি।”
বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে প্রণাম করছেন ঝুম্পা লাহিড়ী।
সঙ্গে লেখিকার বাবা-মা। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।
এখানেই ঝুম্পা লাহিড়ীর ‘বং কানেকশন’। ঝুম্পার আগে-পরে অভিবাসী লেখিকাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সকলেই বাপের বাড়িতে ফিরে ফিরে আসেন। সাহিত্য রচনার জন্য স্বদেশে বিদ্রোহ, বিপ্লবের ইতিহাস বেছে নেন তাঁরা। ঝুম্পা এই উপন্যাসের জন্য বেছে নিয়েছেন নকশাল আন্দোলনের স্মৃতি। আমেরিকাবাসিনী, নাইজিরিয়ার চিমামান্দা এনগুজি তাঁর জন্মের আগে ঘটে-যাওয়া বায়াফ্রা যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন ‘হাফ অব আ ইয়েলো সান’। আর এক মার্কিন-অভিবাসিনী ইথিওপিয়ার মাজা ম্যানজেস্টি হাইলে সেলাসির রাজত্ব নিয়ে গত বছরেই লিখেছেন ‘বিনিথ দ্য লায়নস গেজ’। চিমামান্দা বা মাজা শৈশবে কয়েক বছর স্বদেশে কাটিয়েছেন। কিন্তু ঝুম্পা? তাঁর কলকাতা-সংযোগ মানে তো দু’বছর বয়সে মা-বাবার কোলে চেপে প্রথম কলকাতায় আসা। তার পর পাঁচ বছর বয়সে। এ দিনও সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক আড্ডায় বলছিলেন, “লং আইল্যান্ডে আমার বন্ধুবান্ধবরা জানতই না, কলকাতা কেমন! কলকাতাতেও খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো, মামাতো ভাইবোনেরা আমাকে ‘আউটসাইডার’ ভাবত। ছোটবেলাতেই মনে হয়েছিল, আমার কোনও দেশ নেই। কিংবা সব দেশই যেন আমার নিজের। যেখানে খুশি, যেতে পারি।” বন্ধনহীন এই পথচলা থেকেই সন্ধের আলাপচারিতায় আশাপূর্ণা দেবীর সঙ্গে টমাস হার্ডিকে সহজেই মিলিয়ে দেন লেখিকা।
কলকাতা, লন্ডন এবং রোড আইল্যান্ডের পর এখন আরও একটি শহর ঝুম্পার নিজের। রোম! সেখানেই স্বামী, পুত্র কন্যাদের নিয়ে তাঁর সংসার। “ইতালি অনেকটা আমাদের দেশের মতো। পুরনো সভ্যতা, বাবা মা, আত্মীয়-স্বজন, পারিবারিক বন্ধনের প্রভাব বিশাল,” বলছিলেন তিনি।
কেন বারবার কলকাতায় প্রত্যাবর্তন? ‘দ্য লোল্যান্ড’ উপন্যাসের প্রথমে এই নামই ভেবেছিলেন ঝুম্পা: রিটার্ন। এ দিন সকালে আড্ডায় তাঁর বাংলা অনুবাদককে বলছিলেন, “পরে ভেবে দেখলাম, নামটা ভাল না। বরং লো ল্যান্ড বা নাবাল জমিতে জল জমে, আবার রোদে উবে যায়। আমার চরিত্ররাও সবাই সেই ভাবে টালিগঞ্জের পানাপুকুরে যায়, উবে যায়, ফের আসে। তখনই নামটা বদলে দিলাম।”
ঝুম্পা কি এ ভাবেই জীবনের সঙ্গে লেখাকে মিশিয়ে দেন? আর সেখান থেকেই তৈরি হয় ঘরে ফেরার বিষণ্ণতা? “বিষণ্ণতার কথা অস্বীকার করি না। আসলে আমি কোথায় আছি, কোথায় থাকি সেটা নিছক মানসিক অবস্থান,” ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে বসে বলছিলেন ঝুম্পা। ইংরেজি কথোপকথনে গলা কেঁপে গেল, কোথায় যেন মায়া রহিয়া গেল!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.