গান ভালবেসে পঁচিশ বছর
হেক্সাগোনাল তিন পয়সার কয়েন। অধুনালুপ্ত। তবু কানাডায় আলমারির লকারে রাখা। স্মৃতি মাখা।
আসলে, সে বছরটা কোনও দিন ভুলতে পারবে না পারমিতা। সে বছরই ভারত পোখরানে তিন-তিনখানা পরমাণু বোমা ফাটিয়েছিল। সে বছরই গুজরাতে সাইক্লোনে মারা গিয়েছিলেন হাজারের ওপর মানুষ। আর সে বছরই বিক্রমের প্রেমে হাবুডুবু অবস্থা পারমিতার। দু’জনেই ‘চন্দ্রবিন্দু’র ডাই-হার্ড ফ্যান। কাজেই প্রথম ডেট-য়ের অজুহাত ‘চন্দ্রবিন্দু’-র অনুষ্ঠান, জ্ঞানমঞ্চে।
টিকিটের দামটা অদ্ভূত উনিশ টাকা সাতানব্বই পয়সা। তা নিয়ে বিস্তর হাসাহাসিও হল টেলিফোনে দু’জনের। চমক ছিল আরও। হলের প্রবেশদ্বারেই তিন পয়সা ফেরত দেওয়া হল! “আসলে আমাদের এক বন্ধুর কাকার কাছে প্রচুর এক, দুই, তিন পয়সার খুচরো জমানো ছিল,” জানালেন ‘চন্দ্রবিন্দু’র লিড সিঙ্গার অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, “তাই দিয়েই মজা করে প্রত্যেক দর্শককে তিন পয়সা ফেরত দেওয়া হয়েছিল, মনে আছে। আর সেই সময়ে, ১৯৯৮এ টিকিটের দাম কুড়ি টাকার কম রাখলে সরকারি কর দিতে হত না।”
পারমিতা বিয়ের পর এক দশক কানাডায় থিতু। ছ’ বছরের কন্যার জন্ম ওখানেই।
তবে পারমিতার স্বামীর নাম দেবল চৌধুরী। জীবনে আজ বিক্রম না থাকলেও সেই অ্যালিউমিনিয়ামের ক্ষয়ে যাওয়া তিন পয়সাটা আছে সযত্নে। আছে চন্দ্রবিন্দুও।
গায়ে লাগে না ধুলো
বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু। চন্দ্রবিন্দু একা থাকে না অথচ ‘চন্দ্রবিন্দু’ ছাড়া ‘পঁচিশ’ লেখাও যায় না। বিন্দুতে শুরু হয়ে পঁচিশ বছর পর আজ পূর্ণচন্দ্র। পাড়ার পুজো থেকে কলেজ প্রেম, রকের আড্ডা থেকে শরিকি বাড়িকলহপ্রিয় বাঙালির কোন জিনিসটাই বা সিকি শতক আস্ত থাকে? এমত বঙ্গদেশে এক অর্বাচীন বাংলা ব্যান্ডের বার-তিনেক ভাঙা-গড়া-ভাঙার পর অবধারিত চন্দ্রবিন্দু প্রাপ্তিকে রুখে দেওয়া গেল কোন রসায়নে? চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের মতে, একমাত্র কারণ সদস্যদের কারও ইগো অন্যদের থেকে বড় বয়ে পারস্পরিক বন্ধুত্বের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়েনি। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের কথায়,“আমরাও কলহপ্রিয় বঙ্গসন্তান, কিন্তু ঝগড়া করতে গেলেও তো এক সঙ্গে থাকতে হয়।”
আর এক সঙ্গে না থাকলে? সে কেলেঙ্কারি হয়েছিল এক বার আটালান্টা সিটিতে। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে। সুরজিৎ ও দ্রোণ পৌঁছে গেলেও নিউ জার্সিতে। ফ্লাইট মিস করে ব্যান্ডের বাকি সবাই। আয়োজকরা নাছোড় হাউজফুল শো, সুতরাং গিটার আর কি-বোর্ড শিল্পীকেই গাইতে হবে গান! শেষ পর্যন্ত অবশ্য অন্যরা পরের ফ্লাইটে পৌঁছে শেষ রক্ষা করে।

এইটা তোমার গান
১৯৮৯তে ‘চন্দ্রবিন্দু’র জন্ম হলেও গান রক্ষা করতেই প্রথম অ্যালবামের উদ্যোগ ‘চন্দ্রবিন্দু’র। সালটা ১৯৯৭। মাদার টেরেজার মৃত্যু, ইন্দ্রকুমার গুজরালের প্রধানমন্ত্রিত্ব, কলকাতা বইমেলায় আগুন লাগার মতো মস্ত ঘটনার পাশে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল প্রথম অ্যালবাম‘আর জানি না।’ আত্মপ্রকাশের আসল কারণটা ছিল কিন্তু অস্তিত্বরক্ষা, ভেঙে বললে, গানের অভিভাবকত্ব রক্ষা।
কলেজে মুখে-মুখে ঘোরা সুইট হার্ট, ‘ফাঁকা নাকি’, ‘তা না না’র মতো ‘চন্দ্রবিন্দু’র জনপ্রিয় গান তখন প্রবল প্রতিষ্ঠিত। কিছু গায়ক ঋণ স্বীকার না করেই সে সব গান গেয়ে বেড়াচ্ছিলেন মঞ্চে। অ্যালবাম বের করলে অন্তত প্রায় বেহাত গানগুলোর ওপর স্রষ্টাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেএই ভেবেই প্রথম অ্যালবাম। “তবে প্রথম অ্যালবামটা তত বিক্রি হয়নি,” জানালেন উপল সেনগুপ্ত, “ চন্দ্রবিন্দুর প্রথম তিনটে অ্যালবাম লোকে খোঁজ করে কিনেছিল প্রায় চার বছর বাদে, ‘চ’ অ্যলবামটা হিট করার পর।” সত্যি এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!
উঠে যাওয়া সিঁড়ি
দুরুদুরু বুকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলেন দুই তরুণ। বুক পকেটে সদ্য বের হওয়া নতুন ক্যাসেট। পৌঁছে হতবাক তাঁরা মণিদা আগেই ক্যাসেটটা কিনে শুনেছেন তাঁদের গানবাজনা। নিজেদের পকেট থেকে উনিশ হাজার টাকা দিয়ে যাঁদের প্রথম ক্যাসেট প্রকাশ, কলকাতা-বম্বের প্রায় সব রেকর্ডিং কোম্পানিতে হত্যে দিয়ে দিয়ে কোনও মতে শিকে ছেঁড়া, তাঁদের দ্বিতীয় ক্যাসেট প্রকাশে সাহায্য করেছিল, ‘মণিদা’ গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের দরাজ প্রশংসা। “শুরুর দিকে অবশ্য কলেজ ক্যাম্পাসের বাইরে কেউ বিশেষ আমাদের গান শুনত না,” মুম্বই থেকে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম, ‘চন্দ্রবিন্দু’ ব্যান্ডের প্রাক্তন সদস্য। “তবু মনের আনন্দে, গান শোনানোর আনন্দে থাকতাম আমরা। আমাদের বেসিক বন্ডিংটাই অনেকটা এগিয়ে রাখত ‘চন্দ্রবিন্দুকে,”’ বিশ্লেষণ প্রীতমের।

সে দিয়েছে পাড়ি
একটা সময় না হয় এগিয়ে রাখল, তা বলে পঁচিশ বছর ধরে টিকিয়ে রাখল কারা? নব্বই দশকের কলেজ পড়ুয়ারা তো আজ চল্লিশের কোঠায়। “আমার মতে ‘চন্দ্রবিন্দু’র জাদুটা আছে মৌলিকত্ব আর লিরিকেই,” উদার সাধুবাদ ‘ভূমি’র লিড সিঙ্গার সুরজিতের ‘‘চন্দ্রবিন্দু’ই প্রথম প্রমাণ করে দিয়েছিল, ভাল গান মানেই সিরিয়াস গান নয়। গানে বিস্তর মজা রেখেও ভাল গান হয়।” প্রীতমের মতেও এক দিকে লিরিক এবং অন্য দিকে এনার্জি বছরের পর বছর ‘চন্দ্রবিন্দু’র স্যাটারিক্যাল বা রোম্যান্টিক গানগুলোকে জনপ্রিয় করেছে। “তবে এত বছর ব্যান্ডের মূল কাঠামোটাকে ধরে রাখা, মূল মানুষগুলোর একসঙ্গে থাকা এটা কিন্তু মস্ত ব্যাপার,” বলছেন সুরজিৎ। “আসলে উপল-অনিন্দ্য-চন্দ্রিলের কলেজ জীবনের বন্ধুত্বটাই দারুণ ওয়ার্ক করে গিয়েছে পরবর্তী সময়েও,” ব্যাখ্যা প্রীতমের।
“ মনের আনন্দে, গান শোনানোর আনন্দে থাকতাম আমরা।
বেসিক বন্ডিংটাই অনেকটা এগিয়ে রাখত ‘চন্দ্রবিন্দুকে।
কলেজ জীবনের বন্ধুত্বটাই কাজ করে গিয়েছে পরবর্তী সময়েও।”
প্রীতম

কাছে থাকে ডি মাইনর
কলেজ জীবনের বন্ধুত্ব-ঠাট্টা-ইয়ার্কিটা ‘চন্দ্রবিন্দু’র-অনুষ্ঠানে নিয়ম করে উঠে এসেছে মঞ্চের ওপর। দর্শকদের সঙ্গে ইন্টার্যাকশান, উপল-অনিন্দ্যর সেন্স অব হিউমার, চন্দ্রিলের রেডি উইট শুধু অনুষ্ঠানেই উতরোয়নি, কয়েকবার বড় বিপর্যয় থেকে বাঁচিয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে ভ্যালেনটাইন্স ডে-র দিন এক অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সদনের প্রায় দেড়শো সিটের টিকিট ডবল ছাপা হয়েছিল। এবং বিক্রিও হয়েছিল! হাউজফুল। শো শুরুর আগে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রায় বাইরে যেতে বসেছে, এমন সময় মঞ্চে চন্দ্রিলের আবির্ভাব এবং নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা, যার মোদ্দা কথা: ‘চন্দ্রবিন্দু’ ইচ্ছে করেই কিছু টিকিট বাড়তি ছাপিয়েছে, যাতে ভ্যালেনটাইন্স ডে-র দিন প্রেমিকারা এই অজুহাতে তাঁদের প্রেমিকদের কোলে বসে গান শুনতে পারে!
এর পর অনুষ্ঠানে আর কোনও হইচই হয়নি। শ’খানেক দর্শক সিট না পেয়ে সে দিন মাটিতে বসেই শো দেখেছিলেন। প্রেম দিবসে গান শোনানোই নয়, একটা গোটা প্রজন্মকে প্রেমের কথা জুগিয়েছিল ‘চন্দ্রবিন্দু’। কবীর সুমন-উত্তর যুগে আর কোনও ব্যান্ডই গানের কথার ওপর এতটা জোর দেয়নি। ‘চন্দ্রবিন্দু’র অনন্যতা সেখানেই।

কী জিনিস বানিয়েছ গুরু
বাংলা ব্যান্ড। শব্দবন্ধটা নিয়ে এক সময়ে কম কটাক্ষ হয়নি। বয়স্কদের হাসাহাসি, সমালোচকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেরিয়ে ‘চন্দ্রবিন্দু’র গান কলেজ-ক্যাম্পাস থেকে সটান ঢুকেছে বৈঠকখানায়। এই সিকি শতক ছোঁয়া আত্মবিশ্বাসে ‘চন্দ্রবিন্দু’র এ বছর তাঁদের দশম বেসিক অ্যালবামটা প্রকাশের পরিকল্পনা, পঁচিশ বছরে ব্যান্ড ছেড়ে যাওয়া সমস্ত পুরনো সদস্যদের আবার একজোট করে একটা গ্র্যান্ড কনসার্টের স্বপ্ন, এ বছর লম্বা আমেরিকা ট্যুরের ভিসা করতে গিয়ে সেই স্বপ্নেও স্মৃতি ছায়া ফেলে।
প্রথম দিল্লি ট্যুরের স্মৃতি। নয়ডা কালীবাড়িতে শো। প্রবল ট্র্যাফিকে ফেঁসে পাক্কা এক ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছাল নভিস ‘চন্দ্রবিন্দু।’ উদ্যোক্তাদের তম্বি, গালিগালাজ এবং হুমকি, পরের শিল্পী অনুপ জালোটা এলে মানে মানে বাজনা গুটিয়ে মঞ্চ ছাড়তে হবে। বরাদ্দ মেরেকেটে দশ মিনিট। দশ মিনিট পেরিয়ে এক ঘণ্টা- দু’ঘণ্টা। অনুপ জালোটার পাত্তা নেই। তিনিও নাকি সেই একই ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে যা ‘চন্দ্রবিন্দু’কে ভুগিয়েছিল। এ দিকে ‘চন্দ্রবিন্দু’র নিজেদের গানের ভাঁড়ার প্রায় শেষ। আমদানি করতে হচ্ছে ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’। ‘জ্যামাইকা ফেয়ারওয়েল’ সব কিছু। দর্শকেরা তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ। উদ্যোক্তাদের অবশ্য তখন অন্য রূপ। একান্ত আর্তি “যত টাকা লাগে দেব দাদারা, গানটা চালিয়ে যান।’’
কথা রেখেছে ‘চন্দ্রবিন্দু।’ গান চালিয়ে যাচ্ছে সিকি শতক ধরে। স্বমহিমায়।
টোয়েন্টি ফাইভ নট আউট...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.