বিশ্বকাপার? কি নাম বললেন অ্যান্টনি উল্ফ?
বলেই হেসে ফেললেন সেলেস্টিন ইচেজোনা! বুটের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে মোহনবাগান স্টপারের পরের মন্তব্য, “উলফ না ক্যাট, উল্টো দিকে কে আছে তা নিয়ে ভাবছিই না। মনে রাখবেন আমিও বিশ্বকাপ খেলেছি। নাইজিরিয়ার হয়ে যুব বিশ্বকাপে। শিলংয়ের কর্নেল গ্লেনও তো বিশ্বকাপার ছিল। কিছু করতে পেরেছিল?” থেমে থেমে শেষ কথাগুলো বলার সময় বেশ জেদি মনে হয় তাঁকে। পুরো টিমের মনোভাবের সঙ্গে যা মিশে যায় অনায়াসেই।
আই লিগের এখনকার লাস্ট বয় চার্চিল ব্রাদার্স হঠাৎ-ই সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে এসেছে ফেড কাপের সেমিফাইনালে। তাদের কোচিতে এসে ‘উল্টে দেখুন পাল্টে গেছি’-র পিছনে যে দু’জন ফুটবলারের সংযুক্তি কাজ করেছে তাঁদের একজন ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাকোর বিশ্বকাপার অ্যান্টনি উল্ফ, অন্য জন মিশরের এক নম্বর ক্লাব আল আহেলির আব্দেল হামিদ সাবানা।
উল্টো দিকে মাত্র দু’জন বিদেশি। আপনার হতে চার। অ্যাডভান্টেজ? “অফকোর্স। এটা বড় সুবিধা। কিন্তু চার্চিল অনেক গুছিয়ে নিয়েছে। ওদের টিমে বলবন্ত, লেনির মতো ভাল ফুটবলার আছে।” করিম বেঞ্চারিফা কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রশ্ন হল, আর উল্ফ? “বড্ড ভয় পাচ্ছি। ডেঞ্জারাস” বলে দ্রুত টিম বাসের দিকে পা বাড়ান বাগান কোচ। ফুরফুরে মেজাজ হলেও টিমের মতোই সংযত।
অনুশীলন করতে আসার জন্য বাস নেই। ফিরে যাওয়ার জন্য বাসের অপেক্ষায় ঘণ্টা খানেক বসে থাকতে হচ্ছে ফুটবলারদের। এটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে ওডাফাদের। এ দিনও বাসের জন্য অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত হোটেল থেকে গাড়ি ভাড়া করে বাগান ব্রিগেড এল কোচি স্টেডিয়ামে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধ ঘণ্টা পরে। রাতে ম্যানেজার্স মিটিং শুরু হল পঁয়তাল্লিশ মিনিট দেরিতে। তাতে অবশ্য ‘এটা ঠিক নয়’ বলে রাগ দেখালেও করিম আক্রমণাত্মক নন। সেমিফাইনাল শুরুর আগে কে আর সংগঠকদের চটাতে চায়? বরং গাড়ি বিভ্রাটকে ‘পয়মন্ত’ মনে করছেন বাগান কোচ! |
শেষ চারের প্রস্তুতি। বুধবার বাগান অনুশীলনে করিমের দুই গোলমেশিন ওডাফা-ক্রিস্টোফার। —নিজস্ব চিত্র। |
করিমের হাত ধরেই পাঁচ বছর আগে শেষ বার ফেড কাপ এসেছে বাগানে। আবার তাঁর সামনেই ট্রফি জয়ের হাতছানি ফলে সামনে যা দেখছেন সবই ‘পজিটিভ’ মনে হচ্ছে করিমের। মাসখানেক আগেও কর্তাদের ‘গিলোটিন’-এর নীচে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছিল তাঁকে। সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আপাতত ট্রফি ছাড়া বিশ্বের আর কিছু নিয়ে ভাবতে রাজি নন তিনি। “চার্চিল একদিন বেশি বিশ্রামের সুযোগ পেয়েছে। ঠিক আছে। আমরাও তৈরি।” কোনও ক্ষোভ নেই। ভাবটা এমন, যা খুশি হোক, ট্রফিটা শুধু চাই।
করিম বেঞ্চারিফা বনাম সুভাষ ভৌমিক হলে কোচি স্টেডিয়ামের ম্যাচটা আজ অন্য মাত্রা পেত সন্দেহ নেই। ট্যাকটিক্স আর চতুরতার মিশেলে নব্বই মিনিটের একটা টানটান এপিসোড দেখতে পাওয়াও যেত। কিন্তু মা এবং স্ত্রী-র অসুস্থতার জন্য চার্চিলের সঙ্গে আসতে পারেননি সুভাষ। গোয়া থেকে চলে গিয়েছেন কলকাতাতেই। ফোন করলেই বলে দিচ্ছেন, “আমি এখন টিম নিয়ে ভাবার অবস্থায় নেই।” কিন্তু চার্চিল শিবিরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, অস্থায়ী কোচ মারিয়ানো ডায়াস নাকি হেড কোচের সঙ্গে কথা বলেই স্ট্র্যাটেজি তৈরি করছেন। “ফোনে ওনার সঙ্গে কথা হচ্ছে মাঝেমধ্যে,” স্বীকার করে নিয়েছেন উল্ফ-লেনিদের বর্তমান কোচ মরিয়ানো।
নেতাজির জন্মদিনে চাার্চিল রিজার্ভ বেঞ্চে সুভাষের অনুপস্থিতি করিমকে সামান্য হলেও চিন্তামুক্ত করেছে। কারণ ইতিহাস বলছে, ৫-৩ এর ডার্বি বাদ দিলে এই যুদ্ধে নিউ আলিপুরের ভদ্রলোক বারবার তীব্র সমস্যায় ফেলেছেন মরক্কানকে। “ওকে নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না,” বলার সময় করিম তাই বেশ গম্ভীর। কিন্তু চার্চিলের যা টিম তাতে কি ওডাফা-ক্রিস্টোফারদের থামানো সম্ভব? বুধবার সকালে গতবারের আই লিগ চ্যাম্পিয়নদের অনুশীলন দেখে মনে হল, টিমটা ফিট। এবং একটা মরিয়া লড়াই দিতে প্রস্তুত। তাদের সবচেয়ে বড় সুবিধা কোনও কিছু হারানোর নেই। ফলে কোনও চাপও নেই। যেটা করিমের টিমের আছে। লেনি-বলবন্ত-সাবানা-উল্ফের চতুর্ভুজ আক্রমণই চার্চিলের প্রাণভোমরা। ডেঞ্জল-সঞ্জয় বালমুচুদের মতো ভূমিপুত্রের ইচ্ছাশক্তিও দলের সাফল্যের পিছনে।
বুদ্ধিমান করিমের চোখে সেটা যে ধরা পড়েনি তা নয়। তিনি পাল্টা টোটকাও তৈরি করে ফেলেছেন—ডেনসন আর কাতসুমিকে দিয়ে। এ দিন পুরো মাঠ না পেলেও উল্ফ-বলবন্তরা যাতে বল না পান সে জন্য সাপ্লাই লাইন কাটতে চাইছেন করিম। জোনাল মার্কিং দিয়ে। স্কিমার সাবানার পিছনে ডেনসনকে লাগাচ্ছেন। লেনির পিছনে কাতসুমি। ছোট মাঠে সেটা অনুশীলনও হল। তবে বল নিয়ে নয়, শ্যাডো করে। পাশাপাশি নিজের টিমের রিজার্ভ বেঞ্চ তৈরিতে নজর দিলেন করিমযেখানে রাম মালিক, উজ্জ্বল হাওলাদার, সাবিথরা ছিলেন। বুঝতে অসুবিধা হল না, সামান্যতম আত্মতুষ্টিতে ভুগতে রাজি নয় বাগান।
চার্চিল আই লিগ জিতেছে, কিন্তু ফেড কাপ জেতেনি। আর তিন বছর ধরে বাগানে খেলে কোনও ট্রফি নেই ওডাফারও। আই লিগ জিতলেও ভারতে আসার পর জেতেননি ফেড কাপ। নাইজিরিয়ান গোলমেশিন তাই মরিয়া। “ঈশ্বর জানেন ট্রফি জিতব কি না? উনি সঙ্গে থাকলে সব কিছু সম্ভব। তবে আমরা ভাল খেলছি। ট্রফি পাওয়ার মতো খেলছি।” কিন্তু ওডাফাকে তো সবাই আটকানোর চেষ্টা করে? “ওডাফা, ওডাফা-ই” বলে দিয়েছেন বাগান অধিনায়ক। চোট থাকা সত্ত্বেও। ওডাফার আন্তরিকতার সঙ্গে ক্রিস্টোফারের টিঁকে থাকার লড়াই। প্রীতম-শৌভিক-পঙ্কজ মৌলাদের মতো বঙ্গসন্তানদের জীবনে প্রথম বার এত বড় মঞ্চে নিজেদের চেনানোর সুযোগ এবং জেদ। শিল্টন, ডেনসনদের আলোর নিচে ফেরার উদগ্র ইচ্ছা। করিমের টিমের প্রধান সম্পদ।
চার্চিল ব্রাদার্স পেনাল্টি মারা অনুশীলন করেছে এ দিনও। এবং সেই ছবি তুলতে দেওয়া হয়নি মিডিয়াকে। করিম সেই পথে হাঁটেননি। হয়তো তিনি ধরেই নিয়েছেন, ম্যাচ টাইব্রেকার পর্যন্ত গড়াবে না।
কেরল যেমন সমুদ্র-নদী দিয়ে ঘেরা। করিমের টিমকে তেমনই এখানে ঘিরে রেখেছে গোয়ার তিনটি দল। বেটো-টোলগের ডেম্পো সেমিফাইনালে কালই স্পোর্টিং ক্লুবের মুখোমুখি হচ্ছে। কিন্তু করিম কাকে ফাইনালে চাইছেন? “স্পোর্টিং ক্লুব কিন্তু আই লিগে সবচেয়ে ধারাবাহিক। ভাল খেলছে,” বলে দেন সবুজ-মেরুনের সারথি।
করিম চাচা কি ফাইনালের কথা ভাবতে শুরু করে দিলেন? |
বৃহস্পতিবারে ফেড কাপ (সেমিফাইনাল)
মোহনবাগান: চার্চিল ব্রাদার্স (কোচি ৪-৩০), ডেম্পো: স্পোর্টিং ক্লুব (কোচি ৭-৩০) |