সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ বাদাবনে বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভের হাল হকিকতের খোঁজ নিচ্ছিলেন ওঁরা। অজস্র নদী-নালা-খাঁড়ির আড়ালে কোন পরিবেশে, কী ধরনের ম্যানগ্রোভ পাওয়া যায় খোঁজ চলেছিল তারই।
চেহারা-চরিত্র, জলের তাপমাত্রা, লবণের তারতম্যের নিরিখে তাদের জীবন ধারণ ঠিক কীরকম, মাস ছয়েক ধরে সে ব্যাপারে সমীক্ষা চালানোর সময়ে চামটা দ্বীপের খাঁড়িতে আচমকা চোখে পড়েছিল সুঁচালো পাতা, ঝাঁকড়া সাদা ফুলের একেবারে নতুন প্রজাতির এক ম্যানগ্রোভের। তাঁর অভিজ্ঞ চোখে মনে হয়েছিল, ‘নব্য প্রজাতি’ নিশ্চয়। নিশ্চিত হতে ‘নেচার, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটি’র পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী ওই বিশেষ প্রজাতির ম্যানগ্রোভের নমুনা পাঠিয়েছিলেন বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় (বিএসআই)।
মাস দেড়েক পরীক্ষার পরে সম্প্রতি বিএসআই-এর বিজ্ঞানীরা জানান, বিশ্বজিৎবাবুর অনুমান নির্ভুল। সুন্দরবনের কোর এলাকায় চামটা দ্বীপে পাওয়া অচেনা প্রজাতিটি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের তালিকায় শেষ সংযোজন।
কিন্তু, প্রশ্ন দক্ষিণরায়ের দেশে সে এল কোথা থেকে?
বিএসআইয়ের এক বিশেষজ্ঞ বলেন, “নব্য প্রজাতিটির সঙ্গে অ্যাকেনথাস বা হরগোজা প্রজাতির ম্যানগ্রোভের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল হরগোজার নতুন সংস্করণ হয়তো বা। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে চেহারায় সাদৃশ্য থাকলেও এটি সম্পূর্ণ এক মৌলিক প্রজাতি। তার নামকরণ করা হয়েছে ‘অ্যাকানথাস অ্যালবাস’। কিন্তু কোথা থেকে তার আবির্ভাব ঘটল তা অস্পষ্ট। পৃথিবীর কোনও প্রান্ত থেকে সমুদ্রে ভেসে এসেছে এর বীজ, তা নয়। পাখি বা জলজ প্রাণী দ্বারা পরিবাহিত হয়েও এসেছে বলে মনে হচ্ছে না।”
বিএসআইয়ের তিন গবেষক বি কে সিংহ, এইচ এস দেবনাথ এবং পি গিরিও এই নয়া প্রজাতিটি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, সম্ভবত সুন্দরবনের কোনও প্রত্যন্ত এলাকায় বহু দিন ধরেই এই ধরনের হরগোজা ছিল। ক্রমে বংশ বিস্তারের ফলে এখন খাঁড়ি এলাকায় তার বিস্তার ঘটেছে। উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞরা জানান, ম্যানগ্রোভ সাধারণত তিন ধরনের। প্রকৃত বা ট্রু-ম্যানগ্রোভ, পশ্চাৎ বা ব্যাক-ম্যানগ্রোভ এবং সহযোগী বা অ্যাসোসিয়েট ম্যানগ্রোভ। এই প্রজাতিটিকে প্রকৃত ম্যানগ্রোভ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন তাঁরা।
‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার’ সংক্ষেপে আইইউসিএন, আন্তর্জাতিক ওই পরিবেশ সংস্থার হিসেব বলছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মোহনায় এ যাবৎ ১১০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভের খোঁজ মিলেছে। তার ৮৪টি প্রজাতিই সুন্দরবনে পাওয়া যায়। আইইউসিএন’-এর এক বিশেষজ্ঞ বলেন, “সুন্দরবনে পাওয়া ওই নব্য প্রজাতিটির নিঃসন্দেহে হেতাল, গরান, গেঁওয়ার তালিকায় নতুন অতিথি।”
সেই নতুন অতিথির খোঁজ দিতে পেরে খুশি বিশ্বজিৎবাবুও। তিনি বলেন, “সুন্দরবন এখনও রহস্যময়। এখনও বহু অচেনা উদ্ভিদ, জলজ প্রাণী, পতঙ্গের দেখা মেলে এই বাদাবনে। তারই একটার খোঁজ দিতে পেরে ভাল লাগছে অবশ্যই।” |