দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিজেকে ‘অ্যানার্কিস্ট’ অর্থাৎ নৈরাজ্যবাদী আখ্যা দিয়াছেন। তিনি এবং তাঁহার নেতৃত্বে আম আদমি পার্টির সরকার ও সমর্থকরা দিল্লির রাজপথে যে নজিরবিহীন কাণ্ড ঘটাইয়াছেন, তাহাকে নৈরাজ্যের আবাহন ব্যতীত অন্য কিছু বলা যায় না। সমগ্র বিশ্ববাসী দেখিতেছে, ভারতের একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি পুলিশ তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাঁহার সরকার ও প্রশাসনকে সচিবালয় হইতে রাস্তায় নামাইয়া আনিয়াছেন। শেষ পর্যন্ত দুই তরফের ‘বোঝাপড়া’য় রাজপথ মুক্ত হইয়াছে, প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি শুরু হইতে পারিয়াছে, এই বোঝাপড়ায় কাহার জয়, কাহার পরাজয়, তাহা লইয়া সওয়াল-জবাব চলিতেছে, কিন্তু এ কথা সহজ এবং স্পষ্ট যে, মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রশাসনের মৌলিক শর্ত ও নীতি লঙ্ঘনের এক উৎকট নিদর্শন স্থাপন করিলেন।
কেজরিওয়াল কেন্দ্রের উপর চাপ সৃষ্টি করিয়া ‘অভিযুক্ত’ চার পুলিশ অফিসারের শাস্তি দাবি করিতেছিলেন। তাঁহার মতে, ওই পুলিশ অফিসাররা দিল্লি সরকারের মন্ত্রীদের নির্দেশ অগ্রাহ্য করিয়া অন্যায় করিয়াছেন। দিল্লির পুলিশ যেহেতু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন, দিল্লির নির্বাচিত সরকারের নয়, তাই অভিযুক্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ না-করার দায় কেন্দ্রের উপরেই বর্তায়। দিল্লির পুলিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কাহার হাতে থাকিবে, তাহা লইয়া বিতর্কের অবকাশ অবশ্যই আছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলেও এই প্রশ্ন উঠিয়াছিল, ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত এই প্রসঙ্গে আপন অসন্তোষ জানাইয়াছিলেন। পুলিশের আনুগত্য যদি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে থাকে, আর কেন্দ্র ও দিল্লির শাসক দল যদি আলাদা হয়, তবে পুলিশি আজ্ঞাবহতার জরুরি বিষয়টি ঘুলাইয়া যাইতেই পারে, কারণ এ দেশে প্রশাসন প্রায়শই দলের বশীভূত। কিন্তু তাহার প্রতিবিধানের জন্য কেন্দ্রের উপর চাপ সৃষ্টির এই পন্থা সম্পূর্ণ অনৈতিক। হইতে পারে, সরকার চালাইতে অপারগ অনভিজ্ঞ কেজরিওয়াল মন্ত্রিসভা এ ভাবেই কেন্দ্র কর্তৃক বরখাস্ত হওয়ার বিকল্প অনুসরণ করিতেছিল, যাহাতে ‘শহিদ’-এর মর্যাদায় পুনরায় রাস্তার আন্দোলনে ফেরা যায়। ইহা যদি সত্য হয়, তবে তাহা গণতন্ত্রের পক্ষে, জনাদেশের পক্ষে অত্যন্ত অপমানজনক।
ক্ষমতার আসনে বসিয়াই অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁহার সহকর্মীরা একের পর এক হঠকারী এবং অনৈতিক নির্দেশ দিয়াছেন, দুর্ভাগ্যজনক আচরণ করিয়াছেন, বিপজ্জনক কথা বলিয়াছেন। নিছক ‘অনভিজ্ঞতা’র দোহাই পাড়িয়া এই সব অন্যায়ের ব্যাখ্যা দিলে চলিবে না। এই পরম্পরার মধ্যে একটি মানসিকতার লক্ষণ অতি স্পষ্ট। সরকার তথা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলির উপর নাগরিক সমাজের এক ধরনের বিরক্তি আছে, ক্ষোভ আছে, রাগও আছে। আম আদমি পার্টির উত্থান এবং সাফল্য বহুলাংশে সেই রাগকে পুঁজি করিয়াই। কিন্তু রাগ দেখাইয়া সরকার চালানো যায় না। সরকার চালনার দায়িত্ব হাতে লইবার পরে দলের নায়ক ও উপদেষ্টাদের কাজ ছিল একটি সুশৃঙ্খল শাসনযন্ত্র তৈয়ারি করা। তাহা ‘অন্য রকম’ হইতে পারে, ‘ভি আই পি’র দাপট হইতে মুক্ত, স্বচ্ছ, সংবেদশীল, সৎ এবং শুশ্রূষু একটি প্রশাসন গণতন্ত্রের পক্ষে বিরাট সম্পদ। কিন্তু কেজরিওয়ালরা যাহা করিতেছেন, তাহা অন্য বস্তু, বলিউডের ছবিতে তেমন হাতে-গরম ‘শাসন’-এর দৃশ্য দেখা যায়। প্রশাসন বলিউড নয়, সে কথা বোধ করি তাঁহারা ভুলিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের গুণমুগ্ধ নাগরিক সমাজও তাঁহাদের এই নৈরাজ্যের তাণ্ডব অবলোকন করিয়া সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিতেছেন। সম্ভবত তাহা উপলব্ধি করিয়াই আম আদমি পার্টির বিপ্লবীরা রণে ভঙ্গ দিলেন। এই উপলব্ধির লক্ষণটুকুই আপাতত ভরসা। |