জলের অপচয় রুখতে একাধিক সরকারি প্রকল্প রয়েছে। কোথাও ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পে, কোথাও পরিবেশের কথা ভেবে ১০০ দিনের কাজে নতুন দিঘি তৈরির পরিকল্পনা হচ্ছে। রাজ্য সরকারের এই পরিকল্পনা ঘিরে ব্যস্ত প্রশাসন। অথচ উত্তরবঙ্গের ‘দিঘির শহর’ কোচবিহারে রাজআমলে তৈরি একের পর এক দিঘি দখল হয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।
কোচবিহারের এই ঘটনার কথা জানেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি ইতিমধ্যেই দিঘিগুলির বর্তমান অবস্থা জানতে কোচবিহারের জেলাশাসককে চেয়ারম্যান করে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছেন। সেখানে জেলা ভূমি রাজস্ব আধিকারিক এবং মৎস্য দফতরের ডেপুটি ডিরেকটর রয়েছেন। জেলাশাসক মোহন গাধী বলেন, “ইতিমধ্যেই আমরা একটি সমীক্ষার কাজ শেষ করেছি। দিঘি থেকে দখলদার উচ্ছেদ করা হবে।” |
বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, শহরের অন্তত ১২টি দিঘি পুরোপুরি দখল হয়ে গিয়েছে। আরও অন্তত সাতটি দিঘির চারদিক দখল হয়ে গিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, কোথাও পেশিশক্তির জোরে আবার কোথাও রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাব খাটিয়ে সেই সব পুকুর দখল করে ব্যবসায়িক কেন্দ্র, বাড়ি তৈরি হচ্ছে। বাসিন্দাদের একাংশ জানাচ্ছেন, খুব সুচতুর ভাবে প্রশাসনের অধীন থাকা জলাশয়গুলি বুজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে একটি অসাধু প্রোমোটার চক্র। অভিযোগ, তাদের প্রভাব এতটাই যে বাসিন্দারাও কেউ তা নিয়ে সরব হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। কোচবিহার পুরসভার চেয়ারম্যান বীরেন কুণ্ডুও মেনে নিয়েছেন দিঘি দখলের বিষয়টি। তিনি বলেন, “এর আগে আমরা লালদিঘি দখলমুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছিলাম। সব দিঘি দখলমুক্ত করতে প্রশাসনের সহযোগিতা দরকার। প্রশাসন উদ্যোগী হলে সবরকম সহযোগিতা করব।”
কোচবিহারের পুরনো বাসিন্দারা জানান, পরিকল্পিত ভাবে কোচবিহার শহরটি গড়ে তুলেছিলেন মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ। রাজা মনে করতেন, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে শহর বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দিঘি খনন ও বৃক্ষরোপণের প্রয়োজন রয়েছে। সে জন্য একের পর এক দিঘি খনন করেন তিনি। সেই থেকেই ‘দিঘির শহর’ বলে পরিচিত হয় কোচবিহার। কথিত আছে, গ্রামে গরিব প্রজারা যখন কাজের অভাবে পড়তেন, সে সময়টাকেই রাজা পুকুর খননের সময় হিসেবে বেছে নিতেন। |
তাতে এক বারে দু’টি কাজ হত। সে সময়েই একে একে সাগরদিঘি, রাজমাতাদিঘি, বৈরাগীদিঘি, লালদিঘি, চন্দনদিঘি-সহ অসংখ্য দিঘি তৈরি হয়। দুর্গাবাড়ি সংলগ্ন এলাকায় দু’টি দিঘি তৈরি করেন বাসিন্দারা। রাজ আমলে শহরের সমস্ত জনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি করে পুকুর তৈরি করা হয়। রাজার উদ্যোগে ও পরামর্শে সে সময়ের জমিদারদের অনেকেই নিজের বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় দিঘি খনন করেন। নিউটাউন, ভেনাস স্কোয়্যার, ধর্মতলায় দিঘি তৈরি হয়। ধীরে ধীরে দখল শুরু হয় দিঘির পাড়। ক্রমে তা বাড়তে থাকে। মড়াপোড়া দিঘি-সহ প্রায় ১৫টি দিঘি দখল হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, যা অবস্থা তাতে এই মুহূর্তে ব্যবস্থা না নিলে কয়েক বছরের মধ্যে মোস্তাফিদিঘি, লালদিঘি, চন্দনদিঘি, ধোবিদিঘি-সহ বেশ কয়েকটি দিঘিও দখল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলাশাসক মোহন গাঁধী জানান, দিঘির সৌন্দর্যায়নে কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “সাগরদিঘি দেখতে বিভিন্ন রাজ্য থেকে পর্যটকেরা এখানে আসেন। দিঘি সাজতে সকলের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।”
|
রাজ আমলে কোচবিহার শহরে ২৭টির বেশি দিঘি ছিল |
• সাগরদিঘি, বৈরাগীদিঘি, রাজমাতাদিঘি, বৈরাগীদিঘি, যমুনাদিঘি, ডাঙ্গুরাইদিঘি। এখনও দখল হয়নি
• মোস্তাফিদিঘি, লালদিঘি, চন্দনদিঘি, শিববাড়ির দিঘি, শিব দিঘি, ধোবিদিঘি (দু’টি আছে)। প্রায় চারদিক দখল হয়েছে
• মড়াপোড়া দিঘি, নিউটাউনে কালীমোহন দেবের বাড়ির দিঘি, মসজিদ বাড়ির দিঘি, হাজরাদিঘি, ইসমাইল মিয়াঁর দিঘি, সুভাষপল্লিতে সত্যরঞ্জন দাসের দিঘি, জমিদার শীতল চক্রবর্তীর দিঘি, ভেনাস স্কোয়ারে ভাদুড়ি দিঘি। দখল হয়ে গিয়েছে |
|