|
|
|
|
বিদায় বাংলা, বিদায় রূপকথা |
ঋদ্ধির ব্যাটে সম্মানরক্ষা হল প্রশ্নের থেকে নিষ্কৃতি নয়
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • ইনদওর |
গুনে গুনে ঠিক চৌত্রিশ দিন।
ইডেনে শীতের ডিসেম্বরে উত্তরপ্রদেশ-বধে যে মোহিনী রূপকথার জন্ম দেখেছিল বাংলার ক্রিকেটসমাজ, ভারতীয় ক্রিকেটে চিরকালের ‘ব্রাত্য’ এক মহানায়কের হাত ধরে প্রায় মৃত্যু-সরণি থেকে রঞ্জিতে যে অমর প্রত্যাবর্তনের চিত্রনাট্য দেখেছিল গোটা বঙ্গদেশ, তা সমাপ্ত হল আজ, এই মুস্তাক আলির শহরে এসে। চৌত্রিশ দিন পর।
১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩: ইডেনের সবুজ পিচে রুদ্রপ্রতাপ সিংহ-র উত্তরপ্রদেশকে উড়িয়ে লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র সেঞ্চুরি, অশোক দিন্দার সাত উইকেটে আড়াই দিনে ম্যাচ জয় এবং রঞ্জির রাজপথে হাঁটা শুরু।
২০ জানুয়ারি, ২০১৪: হোলকরের সবুজ আভা পিচে ম্যাচ এখানে আড়াই নয়, তিন দিনে শেষ। জয়ী নয়, এ বার পরাভূত টিমের নাম বাংলা। লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র ব্যাট হুঙ্কার দিল না। অশোক দিন্দাও নির্বিষ থেকে গেলেন। এবং বাংলার মহাপ্রস্থান।
সোমবারের পর চলতি রঞ্জিতে বাংলাকে আর খেলতে দেখা যাবে না। শহরে দেখা যাবে না উদ্দাম আবেগের দৃশ্যপট, দেখা যাবে না কোনও বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন। বরং উঠবে কয়েকটা প্রশ্ন। যা এত দিন পড়ে ছিল অন্তরালে, পরের পর মহানাটকীয় জয়ের সুখে। ঋদ্ধিমান সাহার সেঞ্চুরিতে বাংলার আজ কিছুটা মর্যাদারক্ষা হল। কিন্তু কড়া প্রশ্নাবলি থেকে নিষ্কৃতি নয়। |
হারের পথে। ছিটকে গেল অধিনায়কের স্টাম্প। সোমবার ইনদওরে। |
অদ্ভুত সব রোগ, তার অদ্ভুত সব উপসর্গ। ব্যাটিংয়ে। ক্রিকেটারদের মানসিকতায়। কোথায় নেই?
রোগ ১: টিমে ওপেনিং বলে কোনও বস্তু নেই। যে কোনও দিন, যে কোনও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে স্কোর ম্যাচ শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে ৪০-৪ বা ৮৩-৫ দেখিয়েছে। অরিন্দম দাসের পার্টনার পাল্টানো চলল মরসুমের শেষ পর্যন্ত। প্রথমে রোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, মাঝে অভিমন্যু ঈশ্বরন, শেষে কৌশিক ঘোষ। যাঁর আবার রঞ্জি সেমিফাইনাল কি না অভিষেক ম্যাচ ছিল! রঞ্জি নক আউটের টিমে এত পরিবর্তন?
টিম-প্রস্তাবিত প্রতিষেধক: অরিন্দম দাসের সঙ্গে রোহনকে রেখে দেওয়া। বলা হল, রোহনের চোট ছিল। নইলে তিনিই থাকতেন। রোহন না পারলে কৌশিক ঘোষ। কোচের তাঁকে ভাল লেগেছে।
রোগ ২: ভাল ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যানের অভাব। এবং সেখানেও বিবিধ পরিবর্তন। সিনিয়র-জুনিয়র যুদ্ধ। কখনও শুভময় দাস। কখনও অভিমন্যু ঈশ্বরনকে ওপেনিং থেকে সরিয়ে তিনে। টিমে যোগ্য সাত নম্বরও পাওয়া যাচ্ছে না। ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়কে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চেন্নাইয়ে তামিলাড়ুর বিরুদ্ধে জয়ের উইকেটটা শুধুই তাঁর, আর কিছু নেই। মহারাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি বসলেন, ঢুকলেন সন্দীপন দাস। রেজাল্ট এক ব্যর্থ।
টিম-প্রস্তাবিত প্রতিষেধক: পরের বছর সুদীপ চট্টোপাধ্যায় তিনে। কারণ চারে মনোজ তিওয়ারি থাকবেন। অতএব ওয়ান ডাউন নিয়ে ‘গবেষণা’ বন্ধ। কিন্তু যোগ্য সাত? এখনও উত্তর নেই।
রোগ ৩: ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না অশোক মলহোত্র। টিম হেরেছে, মানতে পারছেন। কিন্তু টিমের কারও কারও ‘সুইসাইডাল মেন্টালিটি’ সহ্য হচ্ছে না। “আরে, প্রথম ইনিংসে জুনিয়ররা পারেনি মানলাম। কিন্তু থার্ড ডে উইকেটে এমন ব্যাট করবে?” ক্রুদ্ধ শোনায় বাংলা কোচের গলা। এবং যুক্তি অকাট্য। অভিমন্যু-র মতো কাউকে কাউকে দেখে মনে হয়েছে ম্যাচটা যে সেমিফাইনাল, সেটাই তাঁরা বুঝতে পারছেন না। অভিমন্যুর এটা চার নম্বর ম্যাচ। তিনি কেন থার্ড ডে-র প্রায় পাটা হোলকর উইকেটে ফ্রন্টফুটে না গিয়ে এলবিডব্লিউ হবেন? তরুণ রক্ত টিমে নিশ্চয়ই প্রয়োজন। কিন্তু কখন কে প্রস্তুত, সেটাও নির্বাচকদের বোঝা প্রয়োজন।
টিম-প্রস্তাবিত প্রতিষেধক: ক্লাব ক্রিকেট খেলে কিছু হবে না। টিমের প্রাক্-মরসুম প্রস্তুতি দরকার বুচিবাবুর মতো টুর্নামেন্টে। উইকেটে পাঁচ ঘণ্টা থাকার মানসিকতা তৈরি প্রয়োজন।
শুনলে খারাপ লাগবে। কিন্তু লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র বাংলা আদতে ছিল সাড়ে চার জনের বাংলা! প্রথম জন, বঙ্গ অধিনায়ক নিজে। দ্বিতীয় জন, অশোক দিন্দা। তৃতীয়, ঋদ্ধিমান সাহা। এবং বাকি দেড় টিমের পড়ে থাকা সাত-আট। আর নামগুলো পরিবর্তনশীল। শিবশঙ্কর পাল বা অরিন্দম দাস-রা স্ফুলিঙ্গ হয়েছেন বড়জোর, কিন্তু চলমান অগ্নিশিখা নন। |
ঋদ্ধিমান: অপরাজিত ১০৮। সোমবার। |
আজই বা ঋদ্ধিমান সাহা কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানকে সঙ্গে পেলেন? সৌরভ সরকার বা অশোক দিন্দাদের মতো টেলএন্ডারদের নিয়ে তাঁকে সমুদ্র-সম ৩৪১ রানের লিড পেরোতে হল। সোমবার সৌরভ বা দিন্দা, কিংবা শিবশঙ্কর যে ব্যাটিংটা করে গেলেন, তা দেখে অরিন্দম দাসদের লজ্জা হওয়া উচিত! শিব দশম উইকেটে ৫৫ রানের পার্টনারশিপ দিয়ে গেলেন ঋদ্ধিকে। সৌরভ সরকার দিলেন পঁয়তাল্লিশ রানের পার্টনারশিপ। দিন্দার একটা বিশাল ছক্কা খুঁজতে গ্যালারিতে লোক পাঠাতে হল! সেখানে অরিন্দম? জঘন্য পুলে আউট। সুদীপ চট্টোপাধ্যায় তখন উল্টো দিকে যা খেলছিলেন, তাতে অরিন্দম স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকলেও ম্যাচটা কাল পর্যন্ত যেত। বাংলা ধন্যবাদ দিতে পারে ঋদ্ধিকে। তাঁর পনেরোটা বাউন্ডারি ও দু’টো ওভার বাউন্ডারি সমেত ১০৮ অপরাজিত বাংলার সম্মানরক্ষা করেছে। ইনিংস হারের অপমান থেকে টিমকে বাঁচিয়েছে। ১৮৮-৭ থেকে টিমকে শুধু ৩৪৭-এ টেনে নিয়ে মহারাষ্ট্রকে আবার নামাননি ঋদ্ধি, প্রতিপক্ষকে বুঝিয়েছেন যে বাংলা সেমিফাইনালে ‘ফ্লুক’-এ ওঠেনি। বুঝিয়েছেন, ঠিকঠাক ব্যাটিং করতে জানলে, এই মহারাষ্ট্রকে হারানো মোটেও কঠিন ছিল না।
যা হয়নি, ভেবে লাভ নেই। বরং যা হয়েছে, তা তো হওয়ার কথা ছিল না। বাংলার যা টিম ছিল, তাতে যুক্তির বিচারে রঞ্জি সেমিফাইনাল হয় না। মনোজ তিওয়ারি, মহম্মদ শামিকেউ তো ছিলেন না। কিন্তু তার পরেও কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে। ময়দান মনে রাখবে, ভগ্নপ্রায় এক টিম নিয়ে ’১৪-র রঞ্জিতে পরপর তিনটে ম্যাচ সরাসরি জিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল বাংলা। মনে রাখবে, ডব্লিউ ভি রামনের তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে জুনিয়র ঋত্বিককে অধিনায়কের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘যাও চ্যাম্পিয়ন, জীবনের বলটা করে এসো!’ মনে রাখবে, বাংলা পেয়েছিল এমন দুঁদে এক অধিনায়ককে, যিনি একা একশো নন। আড়াইশো! এবং যত বার ’১৪-র রঞ্জির স্মৃতি মনে পড়বে, তত বার পরিচিত স্লোগানটাও বোধহয় দিতে ইচ্ছে করবে।
সেলাম, এলআরএস! |
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলা ১১৪ ও ৩৪৮ (ঋদ্ধিমান ১০৮ ন:আ:, সৌরভ ৩৫, দিন্দা ২৫, ফালাহ ৩-১১০)
মহারাষ্ট্র ৪৫৫ ও ৮-০ |
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস। |
পুরনো খবর: ইনিংস হারের ভ্রুকুটির মাঝে ‘পুরু’র মতো হার চায় বাংলা |
|
|
|
|
|