রেল থেকে বঙ্গসন্তানকে ফেরানোর ভাবনা
ইনিংস হারের ভ্রুকুটির মাঝে ‘পুরু’র মতো হার চায় বাংলা
ড্রেসিংরুমের বাইরে বেরিয়ে অবসন্ন শরীরটাকে চেয়ারে ছেড়ে দিলেন লক্ষ্মীরতন শুক্ল। অপমানে মুখচোখ কালো, শূন্য দৃষ্টিতে মাঠের দিকে তাকিয়ে। সামনের টেবিলে পা দু’টো তুললেন কী ভেবে, অস্ফুটে বলতে শোনা গেল, “পরপর দু’দিন রঞ্জিতে আমাদের এ বার খারাপ গিয়েছে? যায়নি, না?”
অশোক মলহোত্রর গলা কেমন কাঁপছে। আর একটু হলে বোধহয় কেঁদেই ফেলবেন! অশোক আজ স্তব্ধ। ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমা চাইছেন, তাঁর টিমের উপর বাংলা সমর্থকদের বিশ্বাস চূর্ণ হয়েছে বলে। “আমি কাল একটু ফাইট চাই, ফাইট। আর কিছু না,” বলতে বলতে টিম বাসে উঠে পড়েন আজীবন ‘খারুশ’ ক্রিকেটের চিরবিশ্বাসী ছাত্র!
বাংলা ম্যানেজার দেবব্রত দাস ভেবে পাচ্ছেন না কী করবেন। উদ্ভ্রান্তের মতো ফোন নিয়ে যাচ্ছেন এ দিক, ও দিক। সোমবারের সন্ধের ফ্লাইট কিছু আছে কি না দেখতে হবে! তাঁর ধারণা হল, তৃতীয় দিন লাঞ্চের পর বা টি ব্রেক এর যে কোনও একটা সময়েই নাকি ম্যাচটা শেষ হচ্ছে। চতুর্থ বা পঞ্চম দিনের নাকি কোনও প্রশ্ন নেই!
আশ্চর্য লাগবে দেখলে। একটা পাঁচ দিনের ম্যাচ, সেটাও আবার রঞ্জি সেমিফাইনাল, অথচ দ্বিতীয় দিন থেকেই কিনা একটা টিমের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজছে! ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের কাউন্টডাউন শুরু! মহারাষ্ট্রকে দ্বিতীয় বার ব্যাট করতে নামানোর ‘অপচেষ্টা’ নিয়ে না ভেবে বলা হচ্ছে, বাংলা অন্তত একটা সম্মানজনক বিদায়ের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পারবে কি না? আজ দিনের শেষ ওভারে কৌশিক ঘোষ আউট হয়ে গেলেন। পড়ে আর ন’টা। ‘লিড’-এর মহাসমুদ্র পেরোতে গেলে দরকার আরও তিনশো পঁচিশ রান! বঙ্গদেশের কোনও জঙ্গি সমর্থকও দুঃস্বপ্নেও ব্যাপারটা ভাববেন কি? বরং অনেক প্রাসঙ্গিক চিন্তা হচ্ছে, বাংলা আর ‘বাঁচবে’ কতক্ষণ? দু’টো সেশন? তিনটে? অলৌকিক কিছু ঘটলে আলাদা ব্যাপার। কিন্তু রবিবার পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, ম্যাচটা বাংলা হারছে। কে জানে, হয়তো বা ইনিংসেও!

বাংলার মুখ। ইনদওরের রবিবাসরীয় বিকেল। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
দুপুরে কলকাতা থেকে ফোনে খোঁজখবর নেওয়ার সময় বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটারদের কেউ কেউ মনে করতে পারছিলেন না, রঞ্জি সেমিফাইনালে উঠে শেষ কবে এমন ‘অত্যাচারিত’ হয়েছে বাংলা। পাঁচ বছর বছর আগে শেষ বার রঞ্জির নকআউট পর্বে ঢুকেছিল বাংলা। তামিলনাড়ুর কাছে ফার্স্ট ইনিংস লিড নিয়ে হারতে হয়েছিল। কিন্তু এমন নৃশংস ভাবে ‘খুন’ হয়ে যায়নি! যে নির্মম অত্যাচার মরাঠি-যোদ্ধারা টানলেন দু’দিন ধরে।
কখনও বোলিংয়ে, কখনও ব্যাটিংয়ে। কোনও দিন সামাদ ফালাহ সাত-সাতটা উইকেট নিয়ে বঙ্গ-ব্যাটিংয়ের সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। কোনও দিন বা মহারাষ্ট্র ব্যাটসম্যানরা রানের ‘সুপারমার্কেট’ খুলে বসলেন! ইচ্ছেমতো সেঞ্চুরি, হাফসেঞ্চুরি। দু’টো সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ হল, যার মধ্যে একটা আবার অষ্টম উইকেটে! চার বছর আগে বাংলার বিরুদ্ধেই অভিষেক ঘটানো সংগ্রাম অতীতকর আজ সেঞ্চুরি করে গেলেন। যিনি কিনা ক্লাস এইট পর্যন্ত ফুটবলই খেলতেন। পরে গেমস টিচার জোর করে ক্রিকেটে ঠেলে দেন।
অভিষেকের দিন সুবিধে করতে পারেননি অতীতকর। রণদেব বসু ওই ম্যাচে একাই দশ উইকেট নিয়ে মহারাষ্ট্রকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ রণদেব নেই, অশোক দিন্দা-শিবশঙ্কর পালরা আছেন। কিন্তু ইনদওরের সুইং-বন্ধু পরিবেশেও তাঁরা কেউ সে দিনের ‘রণ’ হয়ে উঠতে পারলেন না। না নতুন বল, না পুরনো বল দু’টোর একটারও সদ্ব্যবহার করা গেল না। লক্ষ্মী তবু একটু মুভমেন্ট পেলেন। শিব-দিন্দারা সেটাও নয়। সবচেয়ে দুঃখজনক দিন্দার বোলিং। শেষ কবে তাঁকে এমন গোটা দিন ধরে লাইন খুঁজতে দেখা গিয়েছে, মনে করা কঠিন। বিপক্ষের এক নম্বর পেস-অস্ত্র প্রভাবহীন হয়ে পড়লে যা হওয়ার, তাই হল। ১৬৪-৫ থেকে রানটাকে পর্বত-সম পর্যায়ে নিয়ে গেল মহারাষ্ট্র। এলআরএসের অধিনায়কত্বও সময়-সময় দুর্বোধ্য দেখাল। শিবশঙ্কর-দিন্দা পারছেন না দেখে পরিবর্তন হল না। অলরাউন্ডার সন্দীপন দাসকে যুদ্ধে আনা হল অনেক পরে। আবার শেষ দিকে কেন তিনি আনকোরা অভিমন্যু ঈশ্বরনকে দিয়ে লেগ স্পিন করাতে গেলেন, সেটাও বোঝা গেল না। অভিমন্যুকে ইচ্ছেমতো স্ট্যান্ডে ফেলা হল। স্পিনার যদি আনতেই হত, তা হলে সৌরাশিস লাহিড়ী ছিলেন। অভিমন্যুর চেয়ে খুব খারাপ করতেন কি?
কিন্তু এগুলো নয়। বোলিং-ব্যর্থতা, ক্যাচ ছাড়া বড়জোর ইনদওর-বিপর্যয়ের আংশিক কারণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। মূল হচ্ছে, ব্যাটিং-কেলেঙ্কারি। যার জন্যই প্রশ্ন উঠল, টিমের ব্যাটিং-শক্তি বাড়াতে ভিনরাজ্য থেকে আবার কাউকে আনা উচিত কিনা? টিমের জুনিয়রদের কারও কারও সেমিফাইনাল খেলার মানসিকতা নিয়ে সংশয় টিমেই উঠছে। আর ’৮৯-৯০-তে বাংলা রঞ্জি জিতেছিল টিমের ভিনরাজ্যের কিছু দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান ছিল বলে। যেমন, অশোক মলহোত্র। অরুণলাল। এমনকী দীপ দাশগুপ্ত-র নেতৃত্বাধীন বাংলা পরপর দু’বার রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল খেলার সময়ও টিমে রোহন গাওস্কর ছিলেন। যিনি জন্মসূত্রে বাংলার নন। কিন্তু বাংলা ক্রিকেটে অবদান তাঁর বড় কম নয়।
যা নিয়ে ভিন্ন মতপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করা গেল। দীপ দাশগুপ্ত-র মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং। কিন্তু আনলে এমন কাউকে আনতে হবে যে বাকি ক্রিকেটজীবনটা বাংলাকে দেবে। দু’-এক বছরের জন্য এনে লাভ নেই। সিএবি চাইছে না, ভিনরাজ্য থেকে এই মুহূর্তে বাইরে থেকে কাউকে ঢোকাতে। বরং রেলওয়েজ থেকে অরিন্দম ঘোষকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালু হয়েছে। পরিবর্ত চাকরি দিয়ে। আর অশোক মলহোত্র বলে রাখছেন, কাউকে এখনই বাইরে থেকে দরকার নেই। যাঁরা আছেন, তাঁদের দিয়েই হবে।
শুনতে ভালই লাগবে। কিন্তু এটাও সমান যুক্তিযুক্ত যে, নব্বইয়ে বাংলার রঞ্জি জয়ী টপ অর্ডার বর্তমান বাংলার মতো নিয়ম করে গুঁড়িয়ে যেত না। সেখানে একটা অশোক মলহোত্র না পারলে, একটা অরুণলাল থাকতেন। একটা শ্রীকান্ত কল্যাণী না পারলে, একজন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন। বর্তমান বঙ্গ ব্যাটিংয়ে শুধু একজন লক্ষ্মীরতন শুক্ল আর ঋদ্ধিমান সাহা আছে, ব্যস! আর ’৯০-এর রঞ্জি সেমিফাইনালে অশোক নিজেই হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে একটা ২৫৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। কিন্তু আজ তাঁর সংসারের এগারো জন মিলেও ২৫৮ তুলতে পারল না! প্রেক্ষাপট অপরিবর্তিত, সেই রঞ্জি সেমিফাইনাল।
সেমিফাইনালে স্বপ্নের দৌড় শেষ হয়ে গেলেও, বাংলা এ বার যা করেছে, নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। রোজ রূপকথা হয় না, স্বপ্ন দেখারও একটা শেষ থাকে। কিন্তু রোজ স্বপ্ন দেখালে একটা প্রত্যাশাও তৈরি হয়। সম্মানজনক বিদায়ের প্রত্যাশা।
আলেকজান্ডারের কাছে পুরুও হেরেছিলেন। কিন্তু তাঁকে ধ্বংস করা যায়নি!

সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলা ১১৪ ও ১৬-১ (অরিন্দম ব্যাটিং ৭, ফালাহ ১-৭)
মহারাষ্ট্র ৪৫৫ (অতীতকর ১৬৮, বাওনে ৮৯, লক্ষ্মী ৩-৭৬, দিন্দা ৩-১১৪)

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.