|
|
|
|
সাক্ষাৎকার... |
উন্নয়ন মানে শুধু আয়বৃদ্ধি আর পুনর্বণ্টন নয় |
আমরা যদি উন্নয়নকে একটু বড় করে দেখতে চাই, যেখানে উন্নয়ন মানে সার্বিক ভাবে জীবনযাত্রার মানের
উন্নতি— সেটা শুধুমাত্র রোজগারের ওপর নির্ভরশীল নয়। আয়বৃদ্ধি বা পুনর্বণ্টনের কথা না
ভেবেও জীবনযাত্রার সার্বিক উন্নতির জন্য বহু কাজ করা সম্ভব। বললেন অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ |
আপনি কি মনে করেন যে ইউপিএ ভারতের উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনার গতিপথটা বদলে দিয়েছে? প্রত্যেকের জন্য কাজ, শিক্ষা বা খাদ্যের আইনি অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এই অধিকারভিত্তিক কল্যাণনীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে ইউপিএ-র ভূমিকা কতখানি?
আমার মতে, ভারতে আর্থিক বা সামাজিক অধিকারের ক্ষেত্রে যতখানি এগোনো গিয়েছে, তার সঙ্গে কোনও একটি নির্দিষ্ট দল বা জোটকে অঙ্গাঙ্গি করে দেখাটা ভুল। ভারত যত দূর এগিয়েছে— সেটা যতটাই হোক— তা এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক পরিণতি। দুনিয়ার আরও অনেক দেশে এই ধরনের উন্নতি হয়েছে। এটা ঠিক যে ইউপিএ গত দশ বছরে বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। তথ্যের অধিকারের আইন হয়েছে, জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন হয়েছে। কিন্তু, এগুলোর ওপর ইউপিএ-র কোনও মৌরসিপাট্টা নেই। কর্মসংস্থান যোজনার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের একটা মস্ত ভূমিকা ছিল। কেন্দ্র খাদ্য নিরাপত্তা আইন তৈরি করার আগেই বিজেপির শাসনাধীন ছত্তীসগঢ়ে এই আইন হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকার তথ্যের অধিকার আইন তৈরি করার আগেই অনেকগুলো আলাদা আলাদা দলের নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার নিজেদের রাজ্যে এ রকম আইন তৈরি করা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিল।
আরও একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন। ইউপিএ-র প্রথম দফায় সামাজিক উন্নয়নের দিকে যে জোর পড়েছিল, তার পিছনে কিন্তু ইউপিএ-র ভিতরকারই একটা ছোট কিন্তু প্রভাবশালী সংখ্যালঘু অংশের বড় অবদান ছিল। এমনিতে ইউপিএ-র সর্বজনীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রতি বিশেষ দায়বদ্ধতা আছে বলে আমার মনে হয় না। এবং, এই আইনগুলো রূপায়িত করার পথে এটাও একটা বাধা। আমি ইউপিএ-র কৃতিত্বকে খাটো করে দেখাতে চাইছি না, তাদের ভাল কাজগুলো অস্বীকারও করছি না। কিন্তু কেউ যদি বলেন যে ইউপিএ নীতিগত ভাবে আর্থিক ও সামাজিক অধিকারের প্রবল সমর্থক, তবে সেটা মারাত্মক সরলীকরণ হবে।
জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ ইউপিএ-র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কতখানি প্রভাব ফেলেছে?
ইউপিএ-র দু’দফায় যে আইনগুলো তৈরির ক্ষেত্রে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, সেগুলো হল তথ্যের অধিকার আইন, জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন, অরণ্যের অধিকার আইন, অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা আইন, জমি অধিগ্রহণ আইন এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন। এই নীতিগুলোর বেশির ভাগই ইউপিএ-র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অংশ ছিল, এবং সেই প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পর্ষদের কোনও ভূমিকা ছিল না! কিন্তু, তথ্যের অধিকার আইনটিকে বাদ রাখলে, বাকি যে আইনগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, তার প্রতিটির ক্ষেত্রেই উপদেষ্টা পর্ষদ পরিকল্পনা জমা দেওয়ার পর সরকার তাতে প্রভূত পরিবর্তন করেছে। এর বাইরে, উন্নয়ন নীতির ক্ষেত্রে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের বিশেষ ভূমিকা ছিল না।
ভারতে গণবণ্টন ব্যবস্থায় দুর্নীতির যে ঐতিহ্য রয়েছে, তাতে এই ব্যবস্থার মাধ্যমেই সবার খাদ্যের অধিকার সুনিশ্চিত করার চেষ্টা কি হঠকারিতা নয়? তার চেয়ে ফুড স্ট্যাম্পের মাধ্যমে কাজটা করলে ভাল হত না?
গণবণ্টন ব্যবস্থার দুর্নীতি রোধ করার বেশ কিছু উপায় আছে, ব্যবস্থা আছে। ফুড স্ট্যাম্প তার মধ্যে একটা। কিন্তু ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে ফুড স্ট্যাম্পই সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু, যত ক্ষণ না কোনও ব্যবস্থাকে বাস্তবের মাটিতে হাতে-কলমে যাচাই করে দেখা হচ্ছে, তত ক্ষণ তার দোষ-গুণ সম্বন্ধে কিছু বলা মুশকিল। এখনও পর্যন্ত ফুড স্ট্যাম্প একটা তাত্ত্বিক ধারণামাত্র। এই ব্যবস্থা কী ভাবে কাজ করবে, সে বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমি এখনও দেখিনি— পাইলট প্রজেক্টের কথা তো ছেড়েই দিন। আর, বহু জিনিস শুনতে দারুণ লাগে, কিন্তু সেটা যখন প্রয়োগ করা হয়, তখন অনেক ফুটিফাটা চোখে পড়ে। রাজস্থানের কোটকাসিম-এ প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরের মাধ্যমে কেরোসিনের ভর্তুকি দিতে গিয়ে ঠিক এটাই হল। আরও উদাহরণ আছে। যেমন, ব্যাঙ্কের গ্রামীণ প্রতিনিধি। ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি সরাসরি গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে যাবেন এবং তাঁর মাধ্যমেই মানুষ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার আওতায় আসবেন— শুনতে সত্যিই ভাল লাগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজ যতটা হয়েছে, ফলাফল আশাপ্রদ নয়। তার একটা বড় কারণ, এই ব্যবস্থা ঠিকঠাক চালাতে হলে বায়োমেট্রিকস, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনের মতো অনেকগুলো প্রযুক্তিনির্ভর জিনিসের একই সঙ্গে কাজ করা দরকার। যেখানে গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদ্যুৎও নিয়মিত থাকে না, সেখানে সব প্রযুক্তি একই সঙ্গে কাজ করবে, এটা নেহাত দুরাশা।
গণবণ্টন ব্যবস্থার দুর্নীতি রোধ করার কাজে বহু রাজ্য ইতিমধ্যেই বেশ কিছু সহজ কিন্তু কার্যকর পথে হেঁটেছে। কম্পিউটারের ব্যবহার চালু হয়েছে, স্মার্ট কার্ড বিলি করা হয়েছে, স্যোশাল অডিট হয়েছে, রেশন দোকানগুলি বেসরকারি মালিকানা থেকে গোষ্ঠীর মালিকানার অধীন হয়েছে। এতে কাজও হয়েছে। আমার তো মনে হয়, ফুড স্ট্যাম্পের মতো ম্যাজিক বুলেটের সন্ধান না করে এ রকম উদাহরণ থেকে শেখাই ভাল। দুর্নীতি রোধ করার জন্য যত রকম ব্যবস্থা সম্ভব, সবই করতে হবে। |
|
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ দিনকয়েক আগে ঘোষণা করলেন, এ বার থেকে কর্মসংস্থান যোজনায় কাজের পরিমাণ দেখে তবেই মজুরি দেওয়া হবে, শুধু উপস্থিত থাকলেই আর টাকা মিলবে না। আপনার কি মনে হয় না, ২০০৬ সালে যখন এই প্রকল্প তৈরি হচ্ছিল, তখনই এই কথাটি স্পষ্ট করে বললে অনেক সমালোচনা এড়ানো যেত?
একেবারে প্রথম থেকেই গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনার দুটি উদ্দেশ্য— গ্রামে কাজ তৈরি করা এবং সম্পদ নির্মাণ। এবং, গোড়া থেকেই এই প্রকল্পে মজুরি দেওয়ার দুটো পথ স্বীকৃত— কাজের পরিমাণ হিসেবে এবং কাজের সময় হিসেবে। আমার মতে, এটাই হওয়া উচিত। বেশির ভাগ রাজ্যই কাজের পরিমাণ হিসেবে মজুরি দেওয়ার নীতি নিয়েছে। কাজেই, রমেশ নতুন কথা বলেছেন না। তবে এটাও সত্যি যে কাজের পরিমাণ মাপার ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। কাজেই, পরিমাণ মেপে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থাও, অবস্থাগতিকে, সময় মেপে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থায় গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু অন্য দিকে, কাজের পরিমাণ মেপে টাকা দিলেই যে উৎপাদনশীলতা বাড়ে, তারও কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই। তার প্রধান কারণ, যে মুহূর্তে পরিমাণ মেপে টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত করা হবে, সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো কাজ এই প্রকল্পের আওতা থেকে বেরিয়ে যাবে, কারণ সেই কাজগুলোর পরিমাণ মাপা যায় না। পুকুর পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি কাজ, কিন্তু সেই কাজের পরিমাণ মাপবেন কী ভাবে? হিমাচল প্রদেশের মতো রাজ্যে, যেখানে সময় মেপে টাকা দেওয়ার পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেখানে অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি ধরনের কাজ করা সম্ভব হয়েছে। আমার মনে হয়, দুটো রাস্তার মধ্যে একটাকে বেছে না নিয়ে দুটোই চালু রাখা উচিত। যে ধরনের কাজে যে রকম মজুরি কার্যকর, সেখানে সেই ধরনের মজুরি দেওয়ার স্বাধীনতা বজায় থাকা দরকার।
কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কতটা?
রাজ্যের ভূমিকা প্রশ্নাতীত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মসংস্থান যোজনা বা আইসিডিএস-এর মতো প্রকল্প রাজ্য সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়বে। আমি বলব, এই ধরনের প্রকল্পের সাফল্যের জন্য রাজ্য সরকারের দায়বদ্ধ ভূমিকা দরকার। ভারতে কিছু রাজ্যের সরকার এই প্রকল্পগুলিকে কাজ করার সুযোগ হিসেবে দেখে— কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় রাজ্যের মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজের সুযোগ। অন্য দিকে, এমনও কিছু রাজ্য সরকার আছে, যারা এই প্রকল্পগুলোকে দুর্নীতির, পাইয়ে দেওয়ার আখড়া করে তুলেছে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি সামাজিক উন্নয়নের কর্মসূচিগুলো রাজ্য সরকার তৈরি করে, এবং রাজ্য স্তরেই সেই টাকার সংস্থান হয়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে এক জন শিক্ষক বা ডাক্তার কতখানি কাজ করার সুযোগ পাবেন, সেটা দিল্লির মর্জির ওপর নির্ভরশীল হবে কেন? সেটা তো রাজ্যের করার কথা। কিন্তু, দরিদ্র রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় উদ্যোগ সত্যিই দরকার। কেন্দ্রের টাকাতেই সেখানে সামাজিক উন্নয়নের কাজ করতে হবে, অন্তত এই মুহূর্তে।
আপনি সত্যিই মনে করেন, ভারতের এই পাঁচ শতাংশ আয়বৃদ্ধির হার নিয়েও পুনর্বণ্টনের ওপর অনেকখানি জোর দেওয়া সম্ভব? সত্যিই কি আয়বৃদ্ধি আর পুনর্বণ্টনের মধ্যে কোনও বিরোধ আছে যে একটার ওপর জোর দিলে অন্যটার দিকে মন দেওয়া যাবে না?
আমার মনে হয়, আমরা কোন উপায়গুলোর কথা ভাবছি, তার ওপরে অনেকখানি নির্ভর করছে। ধরুন, যদি যৌথ চাষের মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টন করতে চাই, তা হলে কৃষির বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। কিন্তু, ধরুন ব্যক্তি মালিকানার বদলে জমিতে যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হল, কিন্তু চাষের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি পরিবারের হাতে থাকল— তাতে একই সঙ্গে উৎপাদনশীলতা ও সম্পদ বণ্টনের সাম্য বাড়ানো সম্ভব। চিনে বহু দিন ধরে এই ধরনের ব্যবস্থা চালু আছে। ভারতের কিছু জনজাতিও এই নীতি মেনে চাষ করে। পাশাপাশি, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রে যথেষ্ট খরচ করলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারও বাড়ে, সামাজিক সাম্যও বাড়ে।
কিন্তু, উন্নয়নকে শুধু বৃদ্ধি আর পুনর্বণ্টনের চশমা দিয়ে দেখার ভঙ্গিটাই গোলমেলে। এটা একটা পুরনো অভ্যাসের ফল— অর্থনীতির অভ্যাস। রোজগারকেই মানুষের জীবনকুশলতার, ভাল থাকার একমাত্র ভিত্তি হিসেবে দেখার অভ্যাস। জীবনকুশলতা সত্যিই যদি শুধুমাত্র রোজগারের ওপর নির্ভরশীল হয়, তবে, আয়বৃদ্ধি আর পুনর্বণ্টনই তার মান বাড়ানোর একমাত্র পথ। ঠিকই। কিন্তু, আমরা যদি উন্নয়নকে একটু বড় করে দেখতে চাই, যেখানে উন্নয়ন মানে সার্বিক ভাবে জীবনযাত্রার মানের উন্নতি— সেটা স্পষ্টতই শুধুমাত্র রোজগারের ওপর নির্ভরশীল নয়। কেবল আয়বৃদ্ধি বা পুনর্বণ্টনের কথা না ভেবেও জীবনযাত্রার সার্বিক উন্নতির জন্য বহু কাজ করা সম্ভব। যেমন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাড়ানো। প্রশাসন যদি সৎ হয়, তবে সেটা জীবনযাত্রার সার্বিক মান অনেকখানি বাড়ায়। উন্নয়নকে বড় অর্থে ধরলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা তার একটা মস্ত অংশ। আবার, স্কুলশিক্ষার মান উন্নয়নের একটা বিরাট অংশ। সেই মান শুধুমাত্র আয়বৃদ্ধি বা পুনর্বণ্টনের ওপর নির্ভর করে না। আমার মনে হয়, উন্নয়নকে বড় অর্থে দেখার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন। আয়বৃদ্ধি আর পুনর্বণ্টনের সংকীর্ণ খাঁচা থেকে নিজেদের মুক্ত করা দরকার।
|
সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত |
|
|
|
|
|