প্রবন্ধ...
রাষ্ট্র খুব শক্তিশালী, চাইলে সে অনেক কিছুই পারে
সাড়ে চার বছরের রুখসার এখন দিব্যি হেঁটে-হেঁটে স্কুলে যায়। দৌড়োদৌড়ি করলে ডান পা-টা অল্প ব্যথা হয় বটে, তবে সমস্যা হয় না। পা এখন আগের মতো সরুও নেই। বেলেঘাটা পোলিয়ো হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে গত কয়েক বছর।
হাওড়ার সাহাপাড়ার জরি-কর্মী আব্দুল শাহ ও সবেদা বেগমের সেজ মেয়ে রুখসার (ছবিতে) সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে দিল্লি থেকে ঘুরে এসেছে। সামনে আরও বেশ কয়েকটা সভার ডাক রয়েছে। নির্বাচনী অগ্নিপরীক্ষার সামনে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় সরকার তাকে সঙ্গে নিয়েই ‘সরকারি সাফল্য’র উদ্যাপন তথা বিজ্ঞাপন করতে চাইছে। কারণ, ভারত শেষ পর্যন্ত ১৩-র গেরো পার করে ফেলতে পেরেছে!
তিন বছর আগে, ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের অখ্যাত এলাকার এই দরিদ্র বালিকার সঙ্গে দেশের তো বটেই, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যৎ জড়িয়ে গিয়েছিল। ওই দিনই পোলিয়ো মিলেছিল আড়াই বছরের রুখসারের দেহে। সেই বছর ভারতের একমাত্র পোলিয়ো কেস। বড় চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়েছিল দেশ এবং, অবশ্যই, রাজ্য। পরবর্তী তিন বছর যাতে দেশে আর কোনও পোলিয়ো কেস পাওয়া না যায়, সেই চ্যালেঞ্জ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এগারোটা দেশের মধ্যে একমাত্র ভারতে পোলিয়ো শেষ হচ্ছিল না বলে অঞ্চলটিকে ‘পোলিয়ো-মুক্ত’ ঘোষণা করতে পারছিল না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’। নেপাল বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা নেপাল ঢের আগে লক্ষ্যপূরণ করেছে। ভারত ২০০০-এর মধ্যে পোলিয়ো-মুক্তির পরিকল্পনা করেও পারেনি। সম্মানের প্রশ্ন হয়ে গিয়েছিল বিষয়টা। অবশেষে সম্মান রক্ষার আশা মিলেছে। রুখসারের ঘটনার পর তিন বছর অতিক্রান্ত। নতুন কোনও পোলিয়ো কেস মেলেনি দেশে। হু-এর কর্তারা জানিয়েছেন, ২০১৪-র ১৩ জানুয়ারি কেটে যাওয়ার পর ভারতের ঝুলিতে ‘পোলিয়ো-মুক্ত’ তকমা ঢুকে গেলেও খাতায় কলমে সার্টিফিকেট পাওয়ার প্রক্রিয়াটি একটু দীর্ঘ।
হু-এর একটি জাতীয় সার্টিফিকেশন কমিটি থাকে। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পোলিয়ো সংক্রান্ত রিপোর্ট খুঁটিয়ে দেখবে। দেশের কোনও ল্যাবরেটরিতে পোলিয়ো পরীক্ষার জন্য আসা কোনও মলের নমুনা পড়ে আছে কি না, ল্যাবরেটরিতে গবেষণার জন্য কোনও পোলিয়ো ভাইরাস রাখা হয়েছে কি না, সে সব ব্যাপারে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’-এর থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হবে। এর পর তারা বিষয়টি পাঠাবে হু-এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সার্টিফিকেশন কমিটির কাছে। তারা নথিপত্র পরীক্ষা করে চূড়ান্ত ঘোষণা করবে। সব কিছু মিটতে দু’এক মাস সময় লাগবে।
তবে ভারতের মতো বিপুলায়তন দেশ, একশো কোটির উপর জনসংখ্যা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মীয় অপপ্রচার এবং রাজনৈতিক নিস্পৃহতার ঐতিহ্যের মধ্যে শেষ পর্যন্ত পোলিয়ো-মুক্তি সম্ভব হল, এতে হু, ইউনিসেফ উচ্ছ্বসিত। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, শাদ বা এশিয়ার আফগানিস্তান-পাকিস্তানে এখন পোলিয়ো দূর করতে ভারত-মডেল অনুসৃত হচ্ছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি ভারতে প্রতি বছর দু’তিন লাখ পোলিয়ো কেস পাওয়া যেত। নানা দেশে ১৯৮৮ সাল থেকে পোলিয়ো নির্মূল কর্মসূচি শুরু হয়ে যায়। ভারত আড়মোড়া ভাঙে ’৯৫-৯৬ নাগাদ। তা-ও প্রথম প্রথম সার্বিক ভাবে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলির সাহায্য পায়নি স্বাস্থ্য দফতর। কোথাও মানুষের মনে ধারণা হয়েছে, পোলিয়ো প্রতিষেধক খেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। আরও নানা ভুল ধারণা ছিল। যখন তখন মানুষ নানা উপলক্ষে পোলিয়ো টিকা কর্মসূচি বয়কট করছে। সামলানোর প্রশাসনিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। ‘ওটা স্বাস্থ্যের কাজ’ বলে প্রশাসন মুখ ফিরিয়ে থাকত।
২০০০ থেকে প্রশাসনের আচরণে একটা পরিবর্তন আসে। স্থানীয় ক্লাব, মহিলা সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়, এন জি ও, ধর্মগুরু, রাজনীতিক, পঞ্চায়েত প্রধান, স্থানীয় শিশু চিকিৎসকদের কার্যক্রমে জড়িয়ে নেওয়া শুরু হয়। চালু হয় সীমান্ত এলাকা, রেল স্টেশন, হাইওয়ে, বাজার এলাকা, ইটভাটা, বস্তি অঞ্চল ইত্যাদির শিশু, অন্য রাজ্য থেকে আসা শিশু, যাযাবর সম্প্রদায়ের শিশুদের পোলিয়ো খাওয়ানো। পোলিয়ো টিকা নিয়ে একটা বড় সমস্যা ছিল। পাঁচ-ছ’বার টিকা নিয়েও পোলিয়োতে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অনেক পাওয়া যেত। এতে অনেকেরই ধারণা হত, টিকা নিয়ে লাভ নেই। সেই ধারণা কাটাতে লাগাতার সচেতনতা অভিযান চালাতে হয়েছে। শুরু হয় ম্যাজিক শো, পুতুল নাটিকা, গ্রামসভার মাধ্যমে প্রচার। শেষ পর্যায়ে অমিতাভ বচ্চনের ‘দো বুঁদ জিন্দেগিকা’ বিজ্ঞাপনে অসাধারণ সাড়া পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
সবচেয়ে সাধুবাদ প্রাপ্য বিহার ও উত্তরপ্রদেশের। রাজ্য দু’টিতে দেশের মধ্যে সর্বাধিক পোলিয়ো পাওয়া যেত। পশ্চিমবঙ্গে ২০০৩-এর পর থেকে পাওয়া প্রায় সব কেসেই আক্রান্তের দেহে ভাইরাস এসেছিল বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকে। একমাত্র রুখসারের ক্ষেত্রে ভাইরাস আসে দিল্লি থেকে। বিহার-উত্তরপ্রদেশে কাজ না হলে ’১৩-র গেরো’ পেরোনো যেত না।
২০০৮ সালে বিহারের কোশি নদীর তীরবর্তী অঞ্চল পোলিয়ো-প্রবণ বলে চিহ্নিত হয়। পাশাপাশি বিহারের ৪৪টি ও উত্তরপ্রদেশের ৬৩টি ব্লককে ‘সেনসিটিভ’ বলে ঘোষণা করে সরকার। পাঁচ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী নামিয়ে বছরে ১১-১২টা পালস পোলিয়ো রাউন্ড শুরু হয়। এক-একটা রাউন্ড প্রায় ৬ দিন চলত। প্রথমে বুথে, তার পর বাড়ি-বাড়ি। জেলাশাসক ও জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তারা রাত পর্যন্ত বসে তদারকি করতেন। টিকা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে এক বার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে বেনজির ভাবে পদ থেকে নীচে নামিয়ে দিয়েছিল বিহার সরকার। হু-এর তরফে এই দুই রাজ্যের প্রতিটি স্পর্শকাতর বুথের দায়িত্বে রাখা হত এক জন আঞ্চলিক কোঅর্ডিনেটর। উত্তরপ্রদেশে ২০১০ এপ্রিলের পর থেকে, বিহারে সেপ্টেম্বরের পর থেকে কোনও পোলিয়ো কেস মেলেনি।
এ বার সাফল্য ধরে রাখার নতুন লড়াই। সেটা অনেক বেশি কঠিন। ইন্দোনেশিয়া পোলিয়ো-মুক্ত ঘোষিত হওয়ার পরে ২০০৫ সালে সেখানে রোগ ফিরে এসেছিল। একই ঘটনা ঘটে ইয়েমেন-এ। ভারতে নাইজিরিয়া, আফগানিস্তান বা পাকিস্তান থেকে মানুষ আসাযাওয়া করেন। দেশগুলি এখনও পোলিয়ো-মুক্ত নয়। জীবাণু যে কোনও সময় আসতে পারে। প্রতিরোধ কর্মসূচিতে ঢিলে দিলে চলবে না। কোথাও নতুন কেস মিলছে কি না, অনবরত নজরদারি চালাতে হবে।
এক বার পোলিয়ো-মুক্তি ঘোষণার পর টিকা কর্মসূচিতে কিছু পরিবর্তনের কথা ভেবেছে কেন্দ্র। প্রথমত, তারা পালস পোলিয়ো দিবস এবং সাব-ন্যাশনাল টিকাকরণ দিবসের সংখ্যা কমিয়ে রুটিন টিকাকরণে জোর দিতে চায়। কিন্তু ইউনিসেফের হিসাবে (২০১১), বিশ্বে রুটিন টিকা না-পাওয়া শিশুর ৩২ শতাংশ বাস করে ভারতে। রুটিন টিকাকরণের মধ্যে ভারতে পোলিয়ো টিকা পাওয়া শিশুর অনুপাত ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ এ দেশে শিশুদের একটা বড় অংশ টিকায় বঞ্চিত হচ্ছে। রুটিন টিকাকরণ প্রক্রিয়া শক্তিশালী না হলে পোলিয়ো ফিরে আসতে পারে।
সরকারের দ্বিতীয় পরিকল্পনা হল, বছরে যদি তিনটি পালস পোলিয়ো রাউন্ড হয়, তার মধ্যে দু’বার ওরাল ড্রপ দেওয়া হবে আর এক বার ইঞ্জেকশন দেওয়া হবে। এর কারণ হল, ওরাল পোলিয়ো ড্রপ পরিবেশের মধ্যে পোলিয়ো ভাইরাস ছড়ানো আটকায় আর ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া ভ্যাকসিন শিশুর নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে। ইজরায়েল অনেক দিন পোলিয়ো-মুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানকার নদীনালার মধ্যে এখনও পোলিয়োর জীবাণু রয়েছে। যেহেতু ইজরায়েলের শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব ভাল, তাই পরিবেশে থেকে যাওয়া ভাইরাস তাদের দেহে প্রবেশ করতে পারছে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের একাংশ ওরাল ড্রপের বদলে পুরোপুরি ইঞ্জেকশনের পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু এর দাম অনেক বেশি হওয়ায় এবং সব সময় যথেষ্ট পরিমাণ সরবরাহ থাকবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে না পারায় এগোতে পারছে না সরকার।
এ ছাড়া, পানীয় জলে মল মিশে যাওয়া আটকাতে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। ভারতে এখনও ৩৪ শতাংশ মানুষের নাগালে উন্নত পয়ঃপ্রণালী নেই। উদরাময়ের প্রকোপও কমাতে হবে। কারণ বেশি উদরাময় হলে শিশুর শরীরে পোলিয়ো প্রতিষেধক ভাল কাজ করতে পারবে না। শহরের বস্তি এলাকা এবং বড় বড় আবাসনে শিশুরা রুটিন টিকাকরণে পোলিও এবং পালস পোলিয়ো খাচ্ছে কি না, নজরদারি করতে হবে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল, এখনও বহু জায়গায় পোলিয়ো টিকার বিরুদ্ধে অনাস্থা। কলকাতার ১৫ নম্বর বরো, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলায় এই রকম বেশ কিছু ‘রেজিস্ট্যান্ট পকেট’ রয়ে গিয়েছে। অনেক জায়গায় এখনও গোপনে সিডি প্রচারিত হচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, পোলিয়ো খাওয়া মানে সন্তানধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই ভুল ধারণা দূর করতে হবে।
তবে যাবতীয় প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও রুখসারেরা দুর্বল পায়ে জোর ফিরে পাচ্ছে, এটাই আশার কথা। আসলে রাষ্ট্র খুব শক্তিশালী। চাইলে সে অনেক কিছুই পারে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর প্রশাসনিক গোঁ থাকলে বরাবরের জন্য পোলিয়োকে রুখে দেওয়াটা অলীক স্বপ্ন হবে না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.