বহুজনসমাজ পার্টির সর্বাধিনায়িকা মায়াবতী দৃশ্যত আপন ভাবমূর্তি সংস্কারে ব্যগ্র। এই লক্ষ্যেই নিজের ৫৮তম জন্মদিনের উদ্যাপন অতিশয় সাদাসিধে, অনাড়ম্বর ভাবে করিতে দেখা গেল। মঞ্চে দাঁড়াইয়া অনুগামীদের হাত হইতে টাকার মালা পরা নয়, কানে হিরার দুল, গলায় হিরার হার পরিয়া বৈভবের প্রদর্শনীও নয়। মায়াবতীর যে কোনও জন্মদিনের উৎসব যে ভাবে তাঁহার পদতলে পার্টি-সমর্থকদের সম্পদ উজাড় করিয়া দেওয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত হইত, এ বার তাহার নিশ্চিত ব্যতিক্রম ঘটাইলেন বহুজনসমাজ নেত্রী। সমবেত সমর্থকদের মধ্যে কেবল বিলি করা হইল দশ টাকা দামের টুপি, যাহাতে দলের নির্বাচনী প্রতীক হাতির ছবি দেওয়া আছে। টুপিটি দেখিতেও কতকটা গাঁধী-টুপির মতো, সম্প্রতি আম আদমি পার্টি যাহার রাজনৈতিক স্বত্ব হস্তগত করিয়াছে। পরিবর্তনটি স্বাগত।
মায়াবতী বা তাঁহার অনুরাগীরা এত কাল বলিতেন, এই ধরনের প্রদর্শনী দলিতদের মনে এই আশা-ভরসা জোগায় যে, তাঁহাদের মধ্য হইতেও কেহ উচ্চবর্ণের সহিত সব কিছুতে (এমনকী ঐশ্বর্যেও) পাল্লা দিবার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু ক্রমে ভারতীয় রাজনীতির অগ্রাধিকার, ভারতীয় গণতন্ত্রের ছাঁদ ও পরিভাষাতেও পরিবর্তন আসিয়াছে। একটা সময় ছিল, যখন আর্যাবর্তে অনেক রাজনীতিকই নিয়মিত দাঁড়িপাল্লার এক দিকে বসিয়া অন্য দিকে টাকার বাণ্ডিল কিংবা সোনা-রূপার তাগাড় স্থাপন করিয়া নিজেদের ওজন মাপিতেন। সেই অশ্লীলতা ক্রমশ বন্ধ হইবার মুখে। মায়াবতীর মতো কিছু রাজনীতিক তথাপি দলীয় সমর্থকদের ‘উপহার দেওয়া’ ধনসম্পদের ব্যক্তিগত ভাঁড়ারের প্রদর্শনী করিতেন। ইহা যে এই বার বন্ধ হইল, তাহার পিছনে ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তমান ব্যবস্থাটির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই পরিবর্তনের অন্যতম কাণ্ডারী অবশ্যই আম আদমি পার্টি এবং দুর্নীতির জঞ্জালকে সম্মার্জনী তাড়নায় বিদায় করার লক্ষ্যে তাহার রাজনৈতিক কর্মসূচির সাফল্য। মায়াবতীকে নিশ্চিত ভাবে ভাবনায় ফেলিয়াছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল, উত্তরপ্রদেশে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনেও যাহার ভূমিকা থাকিবে।
অন্য যে বিষয়টি তাঁহাকে প্ররোচিত করিয়াছে, তাহা হইল, মুজফ্ফরনগরের দাঙ্গাপীড়িতদের ত্রাণ-শিবিরে অসহায় ফেলিয়া রাখিয়া রাজ্যের শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের শত-শত কোটি-কোটি টাকার জলসা অনুষ্ঠান এবং কুড়ি দিনের ব্যয়বহুল বিদেশ-সফরে গমন। যখন ত্রাণ-শিবিরে শিশুরা ঠাণ্ডায় মারা যাইতেছে, শীতবস্ত্র, পুষ্টিকর খাবার এবং চিকিৎসার অভাবে দাঙ্গাদুর্গতরা চরম হতাশায় দিনাতিপাত করিতেছে, তখন সরকারি কোষাগার নয়ছয় করিয়া শাসক দলের উৎসব নিশ্চয় প্রতিকূল রাজনৈতিক বার্তা দিবে। মায়াবতী সেই সুযোগ কাজে লাগাইয়া সমাজবাদী পার্টির ছাড়িয়া যাওয়া শূন্যস্থান দ্রুত ভরাট করিতে উদ্গ্রীব। উত্তরপ্রদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি, শাসক দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বর্ধমান তাণ্ডব, সংখ্যালঘু জনসাধারণের অসহায় দশা সমাজবাদী পার্টির জনসমর্থনের ভিত দ্রুত আল্গা করিয়া দিতেছে। এক দিকে বিজেপি, অন্য দিকে আম আদমি পার্টি সেই হৃত গণভিত্তি দখলে লইতে তৎপর। প্রবীণ ও দক্ষ খেলোয়াড় মায়াবতী হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকার লোক নন। রাজনীতির তাগিদই তাঁহাকে ঘাসের উপর পা দিতে প্ররোচিত করিয়াছে। তাহা ভারতীয় রাজনীতির পক্ষে সুলক্ষণ। |