প্রাথমিক শিক্ষা লইয়া এই দেশে আলোচনা হয় না, বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। কিন্তু সেই আলোচনার কয়েকটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ রহিয়াছে। যেমন, স্কুলে নাম লিখাইবার হার এবং স্কুলছুটের সংখ্যা লইয়া আলোচনা অথবা শিক্ষায় সরকারি বনাম বেসরকারি উদ্যোগের গুরুত্ব বিষয়ক তর্ক। জরুরি আলোচনা, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু যথেষ্ট যে নহে, একটি সাম্প্রতিক সর্বভারতীয় সমীক্ষার ফল আরও এক বার তাহা স্পষ্ট করিয়া দিল। এই বাৎসরিক সমীক্ষায় দেখা যাইতেছে, আলোচনার মূলস্রোতের বাহিরে থাকা কিছু প্রবণতা উত্তরোত্তর উদ্বেগজনক হইয়া উঠিতেছে। তাহার মধ্যে প্রধান দুইটি সমস্যা: স্কুলে কিছু না শেখা এবং অতি-গৃহশিক্ষকনির্ভরতা। সরকারি বা বেসরকারি, কোনও স্কুলেই ছাত্রদের শিক্ষার মান সন্তোষজনক নহে, কিন্তু সরকারি স্কুলে অবস্থা মারাত্মক। পশ্চিমবঙ্গে গৃহশিক্ষক নিয়োগের প্রবণতা সর্বাধিক। প্রতি পাঁচ জন ছাত্রের চার জনই গৃহশিক্ষকের নিকট, বেশ রকম অর্থের বিনিময়ে, পড়িতে যায়। স্কুলের খাতায় নাম থাকা আর সত্যই লেখাপড়া শিখিবার মধ্যে সম্পর্ক ক্ষীণ হইয়া আসিতেছে, এমন বাস্তব স্বস্তিদায়ক হইতে পারে না। কেন বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেখা এক রকম অসম্ভব হইয়া উঠিতেছে, এই প্রশ্নটিকে শিক্ষাবিষয়ক আলোচনার মূলে লইয়া আসিতে হইবে।
সরকারি স্তরে এই আলোচনা হয় না বটে, কিন্তু গবেষকরা প্রশ্নটি লইয়া চর্চা করিয়াছেন। কিছু কারণ উঠিয়া আসিয়াছে। শিক্ষার অধিকার আইন যে প্রকৃত প্রস্তাবে শিক্ষার একটি মস্ত ক্ষতি করিয়াছে, তাহা মনে করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। এই আইন অনুসারে, শিক্ষককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত পাঠ্যক্রম শেষ করিতে হয়। ফলে, কোন ছাত্র পিছাইয়া পড়িল, কাহার কতখানি মনোযোগ প্রয়োজন, এই কথাগুলি ভাবিবার অবকাশ শিক্ষকদের থাকে না। বেসরকারি স্কুলে বা গৃহশিক্ষকের ক্ষেত্রে এই চাপ নাই, ফলে ছাত্রদের শিক্ষার মানও অপেক্ষাকৃত ভাল। শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, শিক্ষকের উপস্থিতির হার, বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি সমস্যাও বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে কম। সরকারি স্কুলের পাকা চাকুরি দৃশ্যত শিক্ষকদের দায়বদ্ধতা বাড়ায় নাই। প্রতীচী ট্রাস্টের সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, শিক্ষকদের সহিত ছাত্রদের ভাষাগত ফারাক থাকিলেও শিক্ষার মানে তাহার প্রভাব পড়ে। মোট কথা, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা বহুমুখী। কোনও একটি সর্বরোগতাপহর বটিকায় তাহার সমাধান হইবে না। কোথায় কী সমস্যা, পৃথক ভাবে বুঝিয়া প্রতিকারের ব্যবস্থা করা চাই।
গোটা দেশেই সরকারি স্কুলের অবস্থা খারাপ। কিন্তু, যেখানে কেরলের ন্যায় রাজ্যে সত্তর শতাংশ ছাত্রছাত্রী বেসরকারি স্কুলে পড়িতে যায়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই হার মাত্র সাত শতাংশ। অর্থাৎ, এই রাজ্যে সরকারি স্কুলগুলির বেহাল দশা অনেক বেশি প্রভাবশালী। গৃহশিক্ষক-নির্ভরতার চড়া হার এই স্কুলব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার প্রকাশ। দেশের অন্যত্র সরকারি স্কুলগুলিতে যে সমস্যা, তাহা পশ্চিমবঙ্গেও আছে। তাহার সহিত যুক্ত হইয়াছে বাম জমানার একটি মারাত্মক কু-অভ্যাস— শিক্ষকতার চাকুরিকে রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে ব্যবহার করা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হইবার প্রধান, কার্যত একমাত্র, যোগ্যতা শাসকদলের ঝাণ্ডা লইয়া মিছিলে হাঁটা। শাসক বদলাইয়াছে, অভ্যাস পূর্ববৎ। রাজনীতির ঠিক দিকে থাকিতে পারিলেই আর কোনও চিন্তা নাই, অভিজ্ঞতাসঞ্জাত এই বিশ্বাসটি পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলগুলিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করিয়াছে। এই ছবি বদলাইবার দায়িত্ব শাসকদের। শিক্ষকদের দায়বদ্ধ করিয়া তুলিতে হইবে, তাঁহাদের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব লইতে হইবে। প্রাথমিক শিক্ষার মেরুদণ্ড ভাঙিয়া রাখিলে উন্নয়নের পথে হাঁটিবার উপায় নাই। |