ভোরের আলো তখনও ফোটেনি ভাল করে। হাওড়া স্টেশনের ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মের রেলিং-এ হেলান দিয়ে বসেছিলেন তরুণী। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জিন্স। ব্যাগ থেকে কোনও রকমে মোবাইলটি বার করে বাড়িতে ফোন করলেন তিনি।
ঘণ্টা দু’য়েক পরে মা ও মেসোমশাই এসে মেয়েটিকে হাওড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে সোমবার রাতে তাঁকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসকেরা রীতিমতো স্তম্ভিত মেয়েটির অবস্থা দেখে ছিন্নভিন্ন যোনি থেকে মিউকাস মেমব্রেন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্স যেখানে যোনির সঙ্গে যুক্ত, সেই অংশটিও প্রবল আঘাতে ছিঁড়ে গিয়েছে। ক্ষত হয়েছে মলদ্বারেও।
শহরের পার্ক স্ট্রিট এবং শহরতলির কামদুনি-মধ্যমগ্রামের পর ফের গণধর্ষণের অভিযোগ খাস কলকাতার বুকে। ঘটনাস্থল এ বার খিদিরপুর। বাবুবাজার এলাকা থেকে এ দিন মহম্মদ হামিদ ওরফে রাজা বলে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জেরায় সে অপরাধের কথা কবুল করেছে বলে পুলিশের দাবি। হামিদের বাকি সঙ্গীদের খোঁজ চলছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “পুলিশকে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। অপরাধী যে-ই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতাও খুব জরুরি।”
কী করে ঘটল এই ঘটনা? পুলিশ জানিয়েছে, সমস্ত ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া মেয়েটির পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে হাওড়া থানার পুলিশ এবং মেয়েটির মা যা বলেছেন, তার ভিত্তিতে একটি গণধর্ষণের মামলা দায়ের করা হয়েছে।
হাওড়া হাসপাতালে মেয়েটির মা এ দিন সাংবাদিকদের জানান, তাঁর মেয়ে দক্ষিণ কলকাতার একটি পোশাক বিপণিতে কাজ করেন। রবিবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ শপিং মল থেকে বেরিয়ে তাঁর মেয়ে ও দুই সহকর্মী একটি ট্যাক্সি ভাড়া করেছিলেন। রাত পৌনে দশটা নাগাদ ওই দুই সহকর্মী পার্ক সার্কাসে নেমে যান। এর পরে ট্যাক্সিচালক তরুণীর গন্তব্যস্থল হাওড়া যেতে অস্বীকার করেন বলে তরুণীর মায়ের অভিযোগ। তাই ওই ট্যাক্সি নিয়েই খিদিরপুর মোড়ের কাছে পৌঁছন তরুণী। তবে হাওড়া যাওয়ার পথে তরুণী হঠাৎ খিদিরপুর গেলেন কেন, তা নিয়ে তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন রয়েছে। এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, “তরুণী ফোন করে পরিচিত কাউকে খিদিরপুরে ডেকেছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বন্ধু-পরিচিতেরা ষড়যন্ত্র করে ধর্ষণ করেছে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।”
তরুণীর মা অবশ্য অভিযোগ করেছেন, খিদিরপুর মোড়ে চালক তাঁর মেয়েকে ট্যাক্সি থেকে এক রকম জোর করেই নামিয়ে দেন। তরুণী সেখান থেকে বাস ধরে হাওড়া স্টেশন পৌঁছবেন বলে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষার পরেও বাস না পেয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত হাঁটতে শুরু করেন। ওই সময় এক যুবক তাঁকে পিছন থেকে ডাকে। তরুণী ঘুরে তাকালে একটি গাড়ি থেকে দুই যুবক নেমে আসে। তরুণীর মুখ চেপে তাঁকে গাড়িতে তোলে ওই যুবকেরা। ছুরি দেখিয়ে তাঁর মোবাইলটি কেড়ে নেওয়া হয়। মেয়েটির মায়ের অভিযোগ, এর পর একটি মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা লরিতে তুলে নিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করে জনা পাঁচেক যুবক। এর পর রাত বারোটা নাগাদ ওই গাড়িতে চাপিয়ে বাবুঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় তরুণীকে। তাঁকে সেখানে ফেলে পালায় দুষ্কৃতীরা। ফেরত দিয়ে যায় মোবাইল ফোনটি। মেয়েটি তাঁর মাকে জানিয়েছেন, ট্রাকে এক জনের ঝাঁকড়া চুল ছিল। অন্য এক যুবককে ‘রাজা’ নামে ডাকা হচ্ছিল।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, বাবুঘাট থেকে তরুণী হেঁটে হাওড়া পৌঁছেছিলেন বলে তাঁর মা পুলিশকে জানিয়েছেন। কিন্তু তা হলে কোনও টহলদারি পুলিশের নজরে সেটা এল না কেন, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই রকম ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় তরুণী অতটা হেঁটে এলেন কী করে, সে প্রশ্নও রয়েছে পুলিশের মাথায়। পুলিশের একটি দল এ দিন তরুণীর কর্মস্থল, দক্ষিণ কলকাতার শপিং মলটিতে গিয়েছিল। তরুণী যে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ মল থেকে বেরিয়েছিলেন, তার তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। একটি বস্ত্র বিপণিতে তরুণী অস্থায়ী কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন বলে পুলিশের কাছে প্রাথমিক ভাবে খবর। তবে কোন দুই মহিলা সহকর্মীর সঙ্গে তরুণী ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন, তা জানতে পারেনি পুলিশ।
রোগাপাতলা, ছোটখাটো চেহারা। বছর একুশের মেয়েটি এখনও ভয়াবহ আতঙ্ক বা ট্রমার মধ্যে রয়েছেন। তাঁকে অজ্ঞান করিয়ে তাঁর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়েছে। রাত পর্যন্ত তাঁকে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, মেয়েটির বক্তব্যে বেশ কিছু ধোঁয়াশা থাকলেও তিনটি বিষয়ে তদন্তকারীর মোটামুটি নিশ্চিত। এই তিনটি বিষয় হল: ঘটনাটি ঘটেছে একটি দাঁড়িয়ে থাকা লরির ভিতর। একাধিক ব্যক্তি ঘটনায় জড়িত। মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড থেকে হাওড়া স্টেশন থেকে মেয়েটি যে বাড়িতে ফোন করেছিলেন, তা প্রমাণিত। এ দিন রাতে ওয়াটগঞ্জের আজাদ ময়দান থেকে ১৪ চাকার ট্রাকটিকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ জানান, ধৃত মহম্মদ হামিদ জেরায় অপরাধের কথা স্বীকার করেছে। ২৩-২৪ বছরের এই যুবক খিদিরপুর এলাকারই একটি গ্যারাজে কাজ করে বলে জানা গিয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, তার বিরুদ্ধে এর আগেও ছোটখাটো অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের একাংশের দাবি, অভিযুক্ত এই হামিদ ওরফে রাজার সঙ্গে তরুণীর পূর্বপরিচয় ছিল কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, সোমবার ভোরে রাজার মোবাইল ফোনের টাওয়ারের অবস্থান হাওড়া এলাকায় দেখা গিয়েছে। কী করতে সে হাওড়া গিয়েছিল, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। পুলিশের বক্তব্য, নির্যাতিতার সঙ্গে বিস্তারিত কথা না বলতে পারলে ধোঁয়াশা কাটবে না।
এ দিন দুপুরে তরুণীকে দেখতে হাওড়ায় যান রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। পরে তিনি বলেন, “আমি যখন হাসপাতালে ঢুকি তখন ওঁকে সবে অপারেশন থিয়েটার থেকে বার করা হয়েছে। আমার নিজের দুই মেয়ে আছে। চোখে অন্ধকার দেখছিলাম।” রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যও হাসপাতালে তরুণীর সঙ্গে দেখা করেন।
খিদিরপুরের এই ঘটনার পরে মহিলাদের নিরাপত্তা বিপন্ন বলে ফের অভিযোগ করেছেন বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “রাজ্যে কেউই নিরাপদ নয়।” বিজেপি-র হাওড়া জেলা কমিটি হাওড়া হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ দেখায়। বিকেলে হাওড়া সেতু অবরোধ করা হয় ডিওয়াইএফআই-র পক্ষ থেকেও। |