সকালে রোল কল শেষ করে ছাত্রটি প্রার্থনার লাইনে এসে দাঁড়িয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীত শুরু আগেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ঘণ্টাখানেক পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা অষ্টম শ্রেণির ছাত্র রাজেশ হেমব্রম (১৪) মৃত বলে জানান। সোমবার সকালে রাজনগর সিসাল ফার্ম উচ্চবিদ্যালয়ের ওই ঘটনায় গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে ছাত্রাবাস কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
এ দিন দুপুর থেকে পরিবার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ ঘটনার প্রতিবাদে মৃত ছাত্রের দেহ স্কুলে রেখে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। স্কুলে পুলিশ এলে বিক্ষোভকারীরা ছাত্রাবাস সুপার দেবব্রত মণ্ডলকে গ্রেফতারের দাবি জানাতে শুরু করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ চলার পরে পুলিশ অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করলে শেষমেশ ওই বিক্ষোভ থামে। এ দিনই ওই ছাত্রের দেহ ময়না-তদন্তের জন্য দেহটি সিউড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। যদিও সন্ধ্যা অবধি ওই ছাত্রের পরিবারের তরফে পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। |
সুপারকে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত। |
পুলিশ ও ছাত্রাবাস সূত্রে জানা গিয়েছে, সকাল ৭টা নাগাদ প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লুটিয়ে পড়ার পরে সহপাঠী ও ছাত্রাবাসের অন্যান্যদের সহযোগিতায় ধরাধরি করে দেবব্রতবাবু রাজেশকে তার ছাত্রাবাসের বিছানায় পৌঁছে দেন। কিন্তু অভিযোগ, অসুস্থ ছাত্রের চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা না করেই তিনি ছাত্রাবাস ছেড়ে বেরিয়ে যান। সহপাঠীদের থেকে খবর পেয়ে স্থানীয় সাওনাহীড় গ্রামের বাড়ি থেকে সাড়ে ৮টা নাগাদ রাজেশের এক দাদা সহদেব হেমব্রম ছাত্রাবাসে ছুটে আসেন। সহদেববাবু যখন রাজেশের কাছে পৌঁছন তখন সে কথাবলার শক্তি হারিয়েছে। সহদেববাবু জানান, স্থানীয় এক হাতুড়ে চিকিৎসককে ডেকে আনা হলে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তত ক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সকলে মিলে ছাত্রটিকে নিয়ে রাজনগর ব্লক হাসপাতালে পৌঁছলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে জানান। কেন চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে তিনি ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে গেলেন, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি দেবব্রতবাবু। তবে, এই নিয়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় মৃত ছাত্রের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। তার উপর পুলিশকে কিছু না জানিয়েই তিনি মৃতদেহ রাজেশের বাড়িতে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন বলেও অভিযোগ।
রাজনগরের ওই ছাত্রাবাস অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের আওতাধীন। মৃতের সহপাঠীরা জানিয়েছে, রবিবার সকাল থেকেই রাজেশ অসুস্থ ছিল। ওই অবস্থায় রবিবারের প্রার্থনা সেরে নিজের বাড়ি রাজনগরের সাওনাহীড় গিয়েছিল। বিকেল তিনটের সময় ফিরলেও সে দুপুর ও রাতের খাবার খায়নি। ছাত্রাবাসে রাজেশের সঙ্গী দশম শ্রেণির বিশ্বনাথ মুর্মু ও অক্ষয় কিস্কুরা বলে, “ওর মাথা ব্যাথা হচ্ছে বলেছিল। কিন্তু এমনটা হবে ভাবিনি।” রাজেশের বাবা কটা হেমব্রম, মা সোনালি হেমব্রম বলেন, “রবিবার বাড়ি এসে রাজেশ শরীর খারাপের কোনও কথা বলেনি। বাড়িতে চা-রুটি খেয়ে সাবানও কয়েকটি সামগ্রী কেনার জন্য ২০ টাকা নিয়ে হস্টেলে চলে যায়। সময়মতো ওর চিকিৎসা করানো হলে ছেলেকে এ ভাবে মরতে হত না।”
অভিযুক্ত সুপার অবশ্য বলেন, “ভেবেছিলাম ওই ছাত্র অম্বলের জন্য মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছে। তাই কয়েক জন সিনিয়র ছাত্রকে ওর বাড়ির লোককে খবর দিতে বলেছিলাম। ও যে মারা যাবে সেটা ভাবতেও পারিনি।” তাঁর দাবি, রাজেশের আগে থেকে অসুস্থ থাকার কথাও তিনি জানতেন না। ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রসঙ্গে দেবব্রতবাবু বলেন, “এই কাজ করে মাসে মাত্র ১৫০০ টাকা বেতন পাই। আজকের দিনে কি ওই টাকায় সংসার চলে? তাই রোজগারের অন্য ব্যবস্থা করতে হয়েছে। আমি রাজেশের বাড়িতে খবর দেওয়ার কথা জানিয়ে টিউশন পড়াতে গিয়েছিলাম।” অবশ্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক অসিত দে বলেন, “সুপারের উচিত ছিল চিকিৎসক ডাকা কিংবা বাড়ির লোক আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা।” ওই ঘটনায় জেলা প্রকল্প আধিকারিক তথা অনগ্রসরশ্রেণি কল্যাণ আধিকারিক সুভাষ বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া, “বেতন কম, এই অজুহাতে কেউ নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তবে ছেলেটি অসুস্থ ছিল বলেই শুনেছি।”
প্রশাসন ও স্কুল সূত্রে খবর, দফতরের আওতায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজনগরের গাংমুড়ি-জয়পুর অঞ্চলের অলিগড়ে থাকা ওই স্কুল চত্বরে ছাত্রাবাসটি চলছে। ২৬ জন ছাত্র থাকে। এক জন সুপার, এক জন রাঁধুনি ও এক জন সহকারি মিলিয়ে মোট তিন জন রয়েছেন তার দায়িত্বে। ছাত্রাবাসে থাকার কথা সুপারের। কিন্তু তাঁর থাকার জন্য কোনও ঘর নেই। ফলে অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতরের আওতাধীন জেলার ২১টি ছাত্রাবাসের বেশির ভাগ ছাত্রাবাসেই থাকেন না সুপারেরা। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণির ছোট ছেলেরা বা তুলনায় একটু বড় ক্লাসের ছাত্রদের দেখভালের জন্য কার্যত কেউ থাকেন না। এক বছর আগে পর্যন্ত ছাত্রাবাসের ভবনটিরও অবস্থা শোচনীয় ছিল। যদিও এখন নতুন ভবন হয়েছে। এ দিনের ঘটনার পরে অনেকেরই প্রশ্ন, পরিস্থিতি যা, তাতে ওই ছাত্রের ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটল তেমন যে আর কোথাও ঘটবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ ব্যপারে প্রশ্ন করা হলে সুভাষবাবু বলেন, “এত দিন এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। তবে এই ঘটনার পরে জেলার সব ক’টি ছাত্রাবাসের সুপারকে সর্তক থাকতে বলা হবে।”
|