|
|
|
|
শাসক মোকাবিলায় সেবক মোদী দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি
১৯ জানুয়ারি |
ভোটযুদ্ধে এ বার নিরাকার শত্রুর উদ্দেশেই তির ছোড়া শুরু করলেন তিনি!
নিরাকার কারণ, উপযুক্ত সময়ে ঘোষণার কথা বলেও কংগ্রেসের অধিবেশনে ছেলেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করতে দেননি সনিয়া গাঁধী। ফলে এই মুহূর্তে একা নরেন্দ্র মোদীই গোটা দেশে ঘোষিত ভাবে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে মোদী তাই তাঁর বিরুদ্ধে কাউকে দাঁড় না করানোকেই হাতিয়ার করলেন দলের জাতীয় পরিষদের বৈঠকের শেষ দিনে। সনিয়া গাঁধীকে কটাক্ষ করে বললেন, “পরাজয় ও বিনাশ নিশ্চিত জেনে কোনও মা কি ছেলেকে বলি চড়াতে রাজি হয়? মায়ের মন তাই বলছে, ছেলেকে বাঁচাও। এ অবস্থায় কংগ্রেস অধিবেশনে দলকে বাঁচাতেই যাবতীয় কসরত করতে হয়েছে। এখানে আমরা দেশ বাঁচানোর কসরত করছি।”
রাহুল গাঁধী চেনা ছন্দ ভেঙে যথেষ্টই ঝাঁঝালো বক্তৃতা দিয়েছেন দু’দিন আগে। আজ তার জবাব দিতে গিয়ে রীতিমতো ঝলসে উঠলেন মোদী। বুঝিয়ে দিলেন, যে পরম্পরার দোহাই দিয়ে কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা থেকে পিছিয়ে এসেছে, সেটা আদৌ তাদের ঐতিহ্য নয়। সর্দার পটেলকে যখন সকলে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছিলেন, সেই সময় জওহরলাল নেহরু ওই পদে বসেন। ইন্দিরা গাঁধীর হত্যার পরেও আলোচনা ছাড়াই রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৪-এ গোটা কংগ্রেস যখন সনিয়াকেই প্রধানমন্ত্রী করতে চাইছিল, সেই সময় সনিয়াই মনমোহন সিংহের নাম মনোনীত করেছেন। ইতিহাস টেনে খড়গহস্ত মোদীর বক্তব্য, তাঁকে দেখে ভয় পেয়েই ময়দান ছাড়ছে কংগ্রেস। |
|
রাহুলের ঝাঁঝের টক্কর নিতে এখানেই থামেননি মোদী। ভোটের আগে নিজের সামগ্রিক প্যাকেজটি গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে আরও কয়েক ধাপ এগোনোর তাগিদ ছিল তাঁর। তাই নিরাকার শত্রুপক্ষের সঙ্গে নিজের শ্রেণি ও মর্যাদার বিভাজন রেখাটিও এঁকে দিলেন সুকৌশলে। যার মাধ্যমে এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চাইলেন তিনি। বললেন, “ময়দান ছেড়ে পালানোর আরও একটি কারণ রয়েছে। লোকসভায় কংগ্রেস জিততে চায়। কিন্তু মোদীর মতো এক জন চা-ওয়ালার সঙ্গে লড়াই করতে তাঁদের মর্যাদায় বাধে। এত বড় কুলে জন্মে এমন এক জনের সঙ্গে টক্কর নিতে হবে, যাঁর মা আশপাশের বাড়িতে জল দিত, বাসন মাজত! এক গরিব পিছিয়ে পড়া শ্রেণির লোকের সঙ্গে লড়তে হবে? কী লজ্জার বিষয় তাঁদের পক্ষে!” গাঁধী পরিবারের মর্যাদা ও শ্রেণির কথা তুলে মোদী নিজেকে নিতান্তই এক সাধারণ অনগ্রসর ঘরের ছেলে হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেন। বোঝাতে চাইলেন প্রকৃত অর্থেই তিনি আম আদমি, খেটে খাওয়া শ্রেণির মানুষ। মোদীর ভাষায়, “ওঁরা নামদার। আর আমি কামদার।”
আর এই আম আদমি মোদীই আজ কতকটা রাহুল আর কিছুটা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ধাঁচে জনগণের অংশীদারিত্বে সরকার চালানোর কথা বললেন। কেজরিওয়াল যে ভাবে ঘরে-ঘরে গিয়ে জনসংযোগ করেছেন, মোদী জোর দিলেন তাতেও। মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য দল ঘরে-ঘরে গিয়ে অর্থ সংগ্রহের কর্মসূচি নিয়েছে। মোদী নিজেও চা-ওয়ালাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দেবেন। কিন্তু তিনি জানেন, টেলিভিশন আর জনসভার মাধ্যমে ভোট হয় না। হয় কর্মীদের সক্রিয়তার বলে। জনসংযোগে। যার ভিত্তিতে আম আদমি পার্টির উত্থান। নিরাকার কংগ্রেসকে আক্রমণ করেই তাই আম আদমির পথে হাঁটতে শুরু করলেন মোদী। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা দলীয় কর্মীদের বললেন, “বুথই হল মা। লোকসভায় কুড়ি কোটি ভোট যে আনবে, সেই সরকার গড়বে। তার জন্য দশ কোটি পরিবারের কাছে যেতে হবে, মন জয় করতে হবে তাঁদের। তাঁরা যেন বিজেপি ছাড়া আর কিছু না দেখেন।”
কংগ্রেস-বিরোধী হাওয়ায় নিজেকে একমাত্র বিকল্প হিসেবে তুলে ধরলেও জিতে এলে কী করবেন তিনি? দলের কর্মীর কী বলবেন ঘরে-ঘরে গিয়ে? বৈঠকের শেষ দিনে মোদী তাই তাঁর সর্বভারতীয় কর্মসূচি তথা প্রতিশ্রুতির তালিকাও বাতলে দিলেন একে একে।
এই কর্মসূচিতে রাম মন্দির নেই। নেই উগ্র হিন্দুত্ব। আছে শুধু সুশাসনের আশ্বাস। তাতে অবশ্যই মিশে রয়েছে আরএসএস-এর স্বদেশিয়ানার ভাবনা। হিন্দুত্বের স্লোগানকে এ বারের ভোটে সরিয়ে রাখলেও হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার প্রশ্ন ও কাশ্মীর নিয়ে দলের অবস্থানকে গুরুত্ব দিচ্ছেন মোদী। রামলীলা ময়দানে বক্তব্য রাখার আগে তিনি আজ কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলেন। আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভারত সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি উচ্চারণ করেন ডজনখানেক সংস্কৃত শ্লোক। গীতা-উপনিষদ থেকে রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ। যাঁরা মোদীর মুখ থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ শুনতে চান, তাঁদের জন্য এ যেন নরম হিন্দুত্বের টোটকা। পশ্চিমের প্রভাব থেকে যুবকদের বাঁচাতে নেশামুক্তির কথা যেমন বলেছেন, তেমনই স্বদেশি পণ্য বেচে বিশ্ব বাজার ধরার স্বপ্নও দেখিয়েছেন তিনি। স্বপ্নের সাত রঙে ভারতমাতাকে সাজিয়ে তুলতে মোদী বলেছেন, পরিবার ব্যবস্থাকে মজবুত করা, কৃষি-পশু-গ্রাম ঢেলে সাজানো, নারী কল্যাণ, জল-জমি-জলবায়ু রক্ষা, যুবসমাজের উন্নয়ন, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং জ্ঞানকে শক্তিশালী করার কথা।
দলের চোখে তিনি ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ থেকে ‘বিকাশ পুরুষ’ হয়েছেন। সে পথে ভারতের নতুন ব্র্যান্ডিং করার রূপরেখাও শোনান মোদী। মনমোহন সিংহের জমানায় দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়েছেন ভারতের উপরে, থমকে গিয়েছে যুবকদের রোজগারের পথ এই হতাশার পরিবেশ কাটাতে মোদী আজ উন্নয়নের রামধনু স্বপ্নও ফেরি করলেন। মোদী জানেন, সরকারে থাকলে জনমোহিনী পদক্ষেপ করার সুযোগ অনেক। যেমন দু’দিন আগে রাহুল গাঁধী ৯টি থেকে বাড়িয়ে ১২টি গ্যাসের সিলিন্ডার দেওয়ার দাবি করে বসতেই মনমোহন সরকার নড়েচড়ে বসেছে। কাজের নিরাপত্তা প্রকল্পের জোরে গত লোকসভায় কুর্সি ধরে রেখেছে কংগ্রেস। এ বারে তাদের তুরুপের তাস খাদ্যের অধিকার। এই অবস্থায় মোদীকেও এমন কিছু শোনাতে হত, যা কংগ্রেসের তূণীরে থাকা বাণকেও ছাপিয়ে যায় শক্তিতে।
মোদী তাই আজ শুরুই করেন রাহুলকে কটাক্ষ করে। বলেন, “কংগ্রেসের অধিবেশনে দলের কর্মীরা বড় আশা করে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নিয়ে যেতে। ফিরে গেলেন গ্যাসের তিনটে সিলিন্ডার নিয়ে। কিন্তু যদি গ্যাসের গ্রিড করা যায়, তা হলে সিলিন্ডারেরই কোনও প্রয়োজন হবে না।” শুধু তাই নয়, মোদীর ঝুলি থেকে বেরিয়ে এল একের পর এক প্রতিশ্রুতি। বুলেট ট্রেনের চতুর্ভুজ, ১০০টি নতুন শহর, সব রাজ্যে আইআইটি-আইআইএম-এইমস, মূল্যবৃদ্ধি রুখতে সরবরাহ ব্যবস্থা মজবুত করা, দাম নিয়ন্ত্রণ তহবিল, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ, কৃষি পরিকাঠামো, ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প, সামগ্রিক উৎপাদন বাড়ানো এমন আরও কত কী!
মোদীর মতে, শাসক নয় দেশের এখন দরকার এক সেবকের। তাই তাঁর আবেদন, “ষাট বছর আপনারা শাসককে দিয়েছেন। এ বার ষাট মাস এক সেবককে দিন। দেশ ঠিক করুক, তাদের ভাঙা রেকর্ড চাই, নাকি ট্র্যাক রেকর্ড (কাজের খতিয়ান)।”
মোদীর আক্রমণের জবাব এ দিনই দিয়েছে কংগ্রেস। মণীশ তিওয়ারি বলেন, “বিজেপি বরাবরই প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী দেয়। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। আমরা অতীতেও শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী দিয়েছি। জনতার আশীর্বাদ পেলে ফের শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী দেব।” মোদী-বিরোধিতায় পিছনে পড়তে নারাজ নীতীশ কুমারের দল জেডিইউ। তাদের নেতা কে সি ত্যাগীর বক্তব্য, “চা-ওয়ালা নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। কিন্তু বিষ চায়েরবিক্রেতা নয়!” |
পুরনো খবর: হিন্দুত্বকে দূরে রেখেই মোদী বার করলেন সুশাসনের তাস |
|
|
|
|
|