বিট্টুকে কিছুতেই মরতে দেওয়া যাবে না। তাই জন্মের পর থেকে সাড়ে পাঁচ মাস হল, তাকে হাসপাতালে রেখে দিয়ে বাঁচানোর ভার নিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। বাড়ি যেতে পারেনি ছোট্ট ছেলে।
বিট্টু অনাথ বা পরিবারহীন নয়। তার পরিবারে বাবা, মা, ঠাকুমা-সহ আরও অনেকে রয়েছেন। সকলের চোখের মণি সে। তা-ও হয়তো এ বার অন্নপ্রাশনটা হাসপাতালেই করতে হবে। এসএসকেএম হাসপাতালের নিওনেটোলজি-র ‘নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট’ বা ‘নিকু’ই এত মাস ধরে তার ঘরবাড়ি। সেখানকার চিকিৎসক আর নার্সরা হয়ে গিয়েছেন বিট্টুর বর্ধিত পরিবার।
পরিবার-পরিজন থাকা সত্ত্বেও কোনও শিশুকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে এত দিন সরকারি হাসপাতালে রেখে দেওয়া এবং নিকু-র মতো জরুরি জায়গায় একটি শয্যা বরাদ্দ করার নজির প্রায় নেই। স্বাস্থ্যকর্তারাই জানিয়েছেন, শিশুকে ভেন্টিলেশন থেকে বার করা যাচ্ছে না, সেটা অন্য পরিস্থিতি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে শিশু নিকু-র সাধারণ শয্যাতেই রয়েছে। বাড়ি পাঠালে আচমকা ‘স্প্যাজম অ্যাটাক’ থেকে প্রাণসংশয় হতে পারে, এই আশঙ্কাতেই স্বাস্থ্য দফতর তাকে আগলে রেখেছে। এটা নজিরবিহীন। শিশুর অতি দরিদ্র বাবা-মা জানিয়েছেন, তাঁদের কাছে সরকারের থেকে পাওয়া এই যত্ন অপ্রত্যাশিত, অভাবনীয়।
মাত্র ৮৫০ গ্রাম ওজন নিয়ে সময়ের আগে গর্ভের সাত মাসে জন্মেছিল বিট্টু। তার ফুসফুস তখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। এক যমজ ভাই-ও হয়েছিল। কিন্তু জন্মের পরেই তার মৃত্যু হয়। এখন বিট্টুকে সুস্থ করে বাড়ি পাঠানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। |
স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “আমাদের কাছে একটি সদ্যোজাতের মৃত্যুও কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে দম্পতির একটি বাচ্চা জন্মের পরেই মারা গিয়েছে। আর এক বাচ্চা জন্মের পরে শারীরিক কারণে বাড়ি যেতে পারছে না। তাকে যদি সুস্থ না-ই করতে পারলাম, তা হলে এত সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট খোলাই বৃথা।”
প্রচেষ্টায় অনেকটা সফলও স্বাস্থ্য দফতর। এই সাড়ে পাঁচ মাসে এখন ভেন্টিলেটর এবং অক্সিজেন ছাড়াই শ্বাস নিতে পাচ্ছে বিট্টু। ওজন ৮৫০ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে সাড়ে তিন কেজি। মায়ের দুধ খেতে পাচ্ছে। বাবা-মা-চিকিৎসক-নার্সদের ডাকে হাসছে, মুখে নানা রকম শব্দ করছে, কোলে চড়ে ঘুরছে ওয়ার্ডের মধ্যেই।
নিকু-র চিকিৎসক শ্যামল সর্দারের কথায়, “নভেম্বর মাসেও নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে ছিল ছেলেটা। ১৫ দিন আগেও রোজ অক্সিজেন দিতে হয়েছে। এখন অবশ্য ও স্বাভাবিকই আছে। তবে যে কোনও সময়ে অবস্থা খারাপ হতে পারে। ব্রঙ্কো-স্প্যাজম শুরু হতে পারে। তাই ওকে বাড়ি পাঠানোর ঝুঁকি নিতে পারছে না স্বাস্থ্য দফতর। ওর বাড়িতে বিদ্যুৎই আসেনি। হঠাৎ অক্সিজেন দিতে হলে পারা যাবে না।”
২০১২ সালের ৩১ জুলাই এম আর বাঙুর হাসপাতালে যমজ ছেলে হয় রাজপুর নস্করপাড়ার বাসিন্দা দীপিকা পণ্ডিতের। মাত্র ২৮ সপ্তাহে শিশু দু’টির জন্ম হয়েছিল। একটি মারা যায়। অন্যটির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় তাকে সে দিন বিকেলেই এসএসকেএম হাসপাতালের নিকু-তে স্থানান্তরিত করে স্বাস্থ্য দফতর। তার পর থেকে এক দিনের জন্যও বাড়ি যেতে পারেনি বিট্টু। প্রতিদিন সকালে তার মা আসেন। সারা দিন হাসপাতালে ছেলের সঙ্গে কাটিয়ে রাতে বাড়ি চলে যান। বাবাও আসেন মাঝে মাঝে। বাকিটা ডাক্তারবাবু এবং নার্সদের দায়িত্ব।
চিকিৎসক অনিন্দ্য সাহা জানান, জন্মের পরেই ‘রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত হয়েছিল শিশুটি। ফুসফুস পুরোপুরি তৈরি হয়নি বলে শ্বাস নিতে অস্বাভাবিক সমস্যা হচ্ছিল। মস্তিষ্কে ভাল ভাবে অক্সিজেন যাচ্ছিল না, অল্প রক্তক্ষরণও হয়েছে। টানা তিন মাস তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। তার পরে দেড় মাস নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে। এখন পরিস্থিতি কিছুটা ভাল। স্বাস্থ্যকর্তারা এককাট্টা বাড়ি যেতে যত দেরি হয় হোক, বিট্টুকে মরতে দেওয়া যাবে না। |