যন্ত্র থাকলেও যন্ত্রী নেই। অগত্যা যাঁরা আছেন, তাঁদেরই যন্ত্রচালনার সংক্ষিপ্ত তালিম দিয়ে কাজ চালানোর পরিকল্পনা। রাজ্যের সরকারি চিকিৎসাক্ষেত্রে এই নতুন উদ্যোগ ঘিরে ইতিমধ্যে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
টেকনিশিয়ানের অভাবে যাতে ইসিজি, এক্স-রে বা সোনোগ্রাফির মতো জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা আটকে না-থাকে, সে জন্য এখন নার্স-ডাক্তারদের মুখাপেক্ষা স্বাস্থ্য দফতর। কর্তাদের বক্তব্য: প্রয়োজনীয় সংখ্যায় টেকনিশিয়ান না-থাকায় লক্ষ লক্ষ টাকার যন্ত্র কিনেও ফেলে রাখতে হচ্ছে। বড় হাসপাতাল থেকে ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র সর্বত্র এক ছবি। যন্ত্রের ঠিকঠাক রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না। ফলে স্রেফ পড়ে থেকে থেকেই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সমস্যার সুরাহায় উপদেষ্টা বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে টেকনিশিয়ান নেই, সেখানে ইসিজি, এক্স-রে নার্সরাই করবেন। আর মেডিক্যাল অফিসারদের ছ’মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে সোনোলজিস্টের ভূমিকাতেও নামানো হবে। ফলে জেলা হাসপাতালে আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে অসুবিধে থাকবে না বলে কর্তাদের আশা।
উল্লেখ্য, ময়না-তদন্তে গতি আনতে ইতিমধ্যে জেলায় জেলায় বাছাই সরকারি ডাক্তারকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। স্থির হয়েছে, ছ’মাসের ‘মেডিকো-লিগ্যাল অটোপ্সি সার্টিফিকেট কোর্স’ চালু করে জেলায় জেলায় কিছু সরকারি ডাক্তারকে ময়না-তদন্তের পাঠ দেওয়া হবে। এতে যোগ্য ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের অভাব যেমন মিটবে, তেমন বকেয়া ময়না-তদন্তের বোঝাও কমানো যাবে বলে কর্তারা দাবি করেছেন। যদিও পরিকল্পনাটির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে দেরি হয়নি। একই ভাবে নার্স-ডাক্তারদের দিয়ে ইসিজি-সোনোগ্রাফি করানোর উদ্যোগ ঘিরেও সৃষ্টি হয়েছে কিছুটা সংশয়ের বাতাবরণ। কী রকম?
এ প্রসঙ্গে মূলত কাজের চাপের কথাই বলছেন সরকারি ডাক্তার ও নার্সদের বড় অংশ। এই মহলের যুক্তি, বিপুল রোগীর ভিড় সামলাতে এমনিতেই তাঁরা জেরবার। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে বিক্ষোভ, ভাঙচুর লেগেই আছে। বাড়তি বোঝা চাপালে রোগীদের পরিষেবা দেওয়ার মূল দায়িত্বের সঙ্গেই আপস করতে হবে। তাতে চিকিৎসা ও শুশ্রূষার গুণমানে ঘাটতি পড়ার প্রভূত সম্ভাবনা বলে ওঁদের দাবি। বর্ধমানের এক ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্সের কথায়, “ডাক্তারবাবুকে সব সময়ে পাওয়া যায় না। রোগী দেখার কাজটা কার্যত আমাদেরই চালাতে হয়। তার উপরে ইসিজি, এক্স-রে করতে হলে কী করে পারব? একটু এ-দিক থেকে ও-দিক হলেই তো প্রাণ যাওয়ার জোগাড়!” পাশাপাশি সোনোলজিস্টের কোর্স করে সরকারি ডাক্তারদের কী লাভ, সে প্রশ্নও উঠছে। “আমাদের বদলির চাকরি। এখানে না হয় ওটা কাজে লাগবে। কিন্তু শহরে তো ও সব করার অন্য লোক রয়েছে! তা ছাড়া প্রাইভেটে সোনোগ্রাফি করে রোজগারের করতে চাইলেও অনুমতি মিলবে না!” বলেন উত্তরবঙ্গের এক জেলা হাসপাতালের এক ডাক্তার।
বস্তুত এমন চটজলদি প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নামালে রিপোর্টে ভুল আসারও প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকদের অনেকে। সরকারের কী বক্তব্য?
স্বাস্থ্য-কর্তারা অবশ্য আপাতত এ সব সংশয়ে আমল দিতে চাইছেন না। তাঁদের দাবি, নতুন কোনও প্রক্রিয়া চালু করতে গেলে গোড়ায় কিছু প্রতিবন্ধকতা আসবেই। শেষমেশ কাজ শুরু হলে আখেরে মানুষেরই লাভ। স্বাস্থ্য দফতরের ওই পরামশর্দাতা বিশেষজ্ঞ কমিটির (মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এক্সপার্ট গ্রুপ) চেয়ারম্যান সুব্রত মৈত্র বলেন, “বহু জায়গাতেই টেকনিশিয়ান না-থাকায় এক্স-রে, ইসিজি ইত্যাদি করা যাচ্ছে না। যদি নার্সদের ইসিজি এবং এক্স-রে করার তালিম দেওয়া যায়, তা হলে এই সমস্যা মেটানো সম্ভব। পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বহু হাসপাতালে যে সব আলট্রাসোনোগ্রাফি যন্ত্র কেনা হয়েছিল, টেকনিশিয়ানের অভাবে সেগুলোও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। মেডিক্যাল অফিসারদের ছ’মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে সোনোলজিস্ট হিসেবে কাজে লাগালে সেই সমস্যা মিটবে।”
বস্তুত মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিন কয়েক আগে ঘোষণা করেছেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও মহকুমা হাসপাতালে রক্ত ও মল-মূত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ইসিজি, এক্স-রে ইত্যাদির বন্দেবস্ত হবে। পিপিপি মডেলে বহু জায়গায় তেমন ক্লিনিকও হয়েছে। অথচ সমন্বয়ের অভাবে উদ্যোগটি পুরোপুরি সাফল্যের মুখ দেখেনি। এই পরিস্থিতিতে আসল উদ্দেশ্য কী ভাবে সিদ্ধ করা যায়, সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার সমাধানে কমিটির নতুন প্রস্তাব অনেকটা কার্যকর হবে বলে মনে করছেন দফতরের শীর্ষ কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, এই মুহূর্তে প্রচুর টেকনিশিয়ান নিয়োগ সম্ভব নয়। তাই ডাক্তার-নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজ চালানোর ভাবনা যথেষ্ট বাস্তবসম্মত।
তবে ডাক্তারদের দেওয়া সোনোলজিস্টের ছ’মাসের প্রশিক্ষণ যে মেডিক্যাল কাউন্সিলের (এমসিআই)-র স্বীকৃতি পাবে না, সুব্রতবাবু তা মেনে নিয়েছেন। “কিন্তু তাতে কী আসে যায়? কাজের কাজটা তো হয়ে যাবে!” মন্তব্য তাঁর। |