রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৪...
খন, ইস্কুল জীবন। বছর তেরো বয়স—ক্লাস সেভেন। মায়ের কলকাতার বাসা, মণীন্দ্র কলেজের গায়ে, শান্তি ঘোষ স্ট্রিট। মা, অণিমা মুখোপাধ্যায়, বাগবাজার মাল্টিপারপাস ইস্কুলের ‘বড়দি’। বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পরে, খড়দা ছেড়ে, কলকাতার বাড়িতে আমরা দুই বোন ও ঠাকুমা। এক চিলতে গলির ওপর, এক চিলতে বারান্দার কোণে, দেড়খানা ঘরের এক চিলতে আস্তানা। সন্ধেবেলা, মণীন্দ্র-নাইটের ছেলেদের ক্যান্টিনে রোজ টেবিল বাজিয়ে গান— ‘কমরেড লেনিনের আহ্বান’ এবং থেকে থেকেই ‘পেটো’ বর্ষণের আওয়াজ ও গোলাগুলির শব্দ। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার—‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উত্‌স’। প্রতি সন্ধ্যায় হাঁটাপথে, উদ্বিগ্ন মুখে মায়ের বাড়ি ফেরা। ‘নকশাল আন্দোলন’-এর সরব ঘোষণা। মাঝে মাঝেই, মধ্যরাতে গলির মধ্যে দিয়ে, দুদ্দাড় পালানোর শব্দ এবং পুলিশের ধরপাকড়।
মাঝে মাঝেই ভারী বুটের আওয়াজ। বয়েস না মেনে, পাড়া উজাড় করে বাচ্চা-বুড়ো সমস্ত ছেলেদের সারবন্দি করে পুলিশভ্যানে তোলা। যে যেমন অবস্থায় ছিল, সে ভাবেই হিঁচড়ে, বেয়নেটের খোঁচায়—দু’হাত ওপরে তুলে, লুঙ্গি পায়জামা পরা দাদা কাকুদের দল। সন্ধের পর শুনশান রাজপথ। অথচ তারই মধ্যে ইস্কুলে নিয়ম মেনে সরস্বতীপুজো—কুমোরটুলি—হলুদ শাড়ি, বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ভুলস্বর্গ ও চিত্রাঙ্গদার মহড়া।
হঠাত্‌ই, একটা পোস্টকার্ড ডাকবাক্সে, মা’কে সম্বোধন করে। অবিলম্বে ইস্কুল বন্ধ করে দেওয়ার কড়া নির্দেশ। অন্যথায় তাঁর দুই মেয়েকে উধাও করে দেওয়ার হুমকি। মা’কে বুকে জড়িয়ে ধরে, ঠাকুমার ঝরঝর করে কান্না। আমরা দুই বোন, বিহ্বল দর্শক— তেরো আর এগারোর দুটি কিশোরী। শহরের চালচলনে আনাড়ি। না-শহুরেই বলা চলে।
১৯৭২ সালে শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের আঁকা ছবি ‘হোমেজ টু—’।
বিষয়: নকশাল আন্দোলনের অশান্ত সময়।
পর দিন, একই নিয়মে মা ইস্কুলে পৌঁছলেন। সঙ্গে ওই ইস্কুলেরই ছাত্রী আমরা দুই বোন। ফেরবার পথে, আমাদের বললেন, সাবধানে বাড়ি চলে যেতে। মা ফিরলেন, বেশ খানিক পরে। এর পর প্রায়ই মায়ের দেরি হতে থাকল। ঠাকুমার সঙ্গে তাঁর আলোচনায় জানলাম, কয়েকটি নকশাল ছেলে, ইস্কুল ছুটির পর, তাঁর কাছে আসে। পিছনের তালাবন্ধ গেট টপকে ঢুকে। তাঁর ঘরে বসেই, মিটিং করে। মা’কে বোঝায়, প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে। শুনলাম, তারা সকলেই ওই পাড়ার এবং ভাল ভাল ইস্কুল-কলেজেরই ছাত্র। লেখাপড়া মুলতুবি রেখে, নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। মায়ের টেবিলে দেখলাম, একটি ফোল্ডারে রাখা ‘দেশব্রতী’ কাগজের কয়েকটি সংখ্যা এবং বেশ কিছু লিফলেট।
এক দিন শুনলাম, অন্যান্য ইস্কুলের হেডস্যর এবং বড়দিরা মিলে, থানা-পুলিশ করবেন কি না, ভাবছেন। মা অসম্মত। ইতিমধ্যে জানা গেল, তাদেরই সূত্রে সম্ভবত, কোনও এক ছাত্রী বেনামে উঁচু ক্লাসে ভরতি হয়েছে, যে এক জন ছাত্রনেত্রী এবং কট্টর নকশাল। মাসখানেকের মধ্যে কানাঘুষো শুরু হল। ইস্কুলের দেওয়ালের পোস্টারও নাকি তারই তত্ত্বাবধানে লেখা। মা, একই রকম শান্ত এবং বিকেলের মিটিং চালিয়ে যাওয়াতেও অনুদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যেই এক দিন, সজ্জন-প্রস্তাব নিয়ে সুরক্ষার হাল-হকিকত বুঝতে মায়ের কাছে ইস্কুলে চলে এলেন শ্যামপুকুর থানার ও.সি.। মা, শুনলাম, দেখা না করে অনুমতি নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে তাঁকে দেখা করবার নির্দেশ দিয়েছেন। দু’দিন বাদেই তিনি বাহিনী নিয়ে ইস্কুল রেড করতে এলেন, গা ঢাকা দেওয়া নকশাল নেত্রীটিকে ধরতে। মা রুখে দাঁড়ালে, অসভ্যের মতো গলা উঁচিয়ে মা’কে তিনি বললেন, ‘মিথ্যে কথা বলবেন না।’ মা শান্ত হয়ে তাঁকে বললেন, ইস্কুল চত্বরের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি যেন মা’কে মিথ্যেবাদী বলার স্পর্ধা দেখান। সে দিনের মতো ও.সি. মহাশয় ফিরে গেলেও, মাঝে মাঝেই দেখা যেতে লাগল, অচেনা মুখের আনাগোনা, ইস্কুলের আশেপাশে, যখন-তখন। মা সাবধান করে বললেন, প্লেন-ড্রেস পুলিশ নজর রাখছে।
আমরাও নজর করলেই দেখতে পেতাম তাদের। হঠাত্‌ই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করত, খুকি কোথায় যাবে? বা অমুক বন্ধুর দাদার নাম কী? কখনও প্রশ্ন না করে শুধুই অনুসরণ। কোথাও থেমে গেলে সেও থামত, আমরা ফুচকা খেলে সে আলুকাবলি। আমরাও কখন যেন অভ্যস্ত হয়ে গেলাম এই নজরদারিতে। এমনও হয়েছে, প্রিয় বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখেছি, তার পুলিশমামা আদর দেখিয়ে, হাতে-লেখা ‘দেশব্রতী’র নকল সামনে ফেলে জানতে চাইছেন, হাতের লেখাটা চেনা লাগছে কি না! বাড়ি এসে মা’কেও জানাইনি। শুধু সাবধান হয়ে গেছি ‘ওদের’ প্রশ্রয় দেওয়া বড়দির মেয়ে বলে।
ইতিমধ্যে মায়ের কথায়, আভাসে-ইঙ্গিতে জেনেছি যে, সেই আগন্তুক ছেলেগুলির নাম কাবুল, পুরু, বিদ্যুত্‌। উত্‌সুক চোখে, জ্বলন্ত বিদ্রোহ নিয়ে তারা মায়ের কাছে আসে এবং ফিরে যায়, তাঁর হাতে বানানো কেক খেয়ে। রাতের খাবারের পর মা’কে দেখি চুপ করে বসে থাকতে। কখনও একা, কখনও ঠাকুমার পাশে। দেখতে দেখতে উত্তাল হয়ে উঠতে থাকে বাগবাজার-শ্যামবাজার-শোভাবাজার অঞ্চল। খবর আসতে থাকে, তরুণ আন্দোলনকারীদের ধরা পড়া ও মারা যাওয়ার কথা। বড়দের সমস্ত আলোচনার বিষয় রাজনীতি। কংগ্রেস-ফরওয়ার্ড ব্লক-সিপিএম এবং নকশাল।
হঠাত্‌ই মাঝরাতে, দরজায় কড়া নাড়া শুনে, মা উঠে আসেন, পিছন পিছন আমিও। দরজা খুলেই মায়ের বিস্ময়— ‘বিদ্যুত্‌ তুমি!’ ছেলেটি বলে, ‘পালাতে হবে। এক বার প্রণাম করতে এলাম, আপনাকে।’ অন্ধকারে মায়ের পা ছুঁয়েই সে দুদ্দাড় নেমে চলে যায়। পর দিন, ভোর রাতে, গলির মধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয় বছর আঠারোর কাবুল। প্রতিবেশীরা কেউ সাড়া না দিলেও, যে একটি শরীর অসহায় কান্নায় আছড়ে পড়ে, সে হল কাবুলের মা। সে দিনই বিকেলের পোস্টার, দেওয়ালে দেওয়ালে
‘কাবুল-পুরু-বিদ্যুত্‌
তোমাদের মৃত্যু থাইপাহাড়ের চেয়েও ভারী’।

অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় ইস্কুল। অন্ধকার বারান্দায় বসে বসে, মা শুনতে থাকেন, পর পর গুলির শব্দ। বুঝতে চেষ্টা করেন, বিদ্যুত্‌কে মারতে ঠিক ক’টা গুলি খরচ হয়েছিল! কোন গুলির শব্দটায় সে নিশ্চিহ্ন হল আর, কোনটায় পুরু পুরুষোত্তম! বিছানায় জেগে বসে শুনতে পাই মা গাইছেন, ‘যে ফুল ঝরে সেই তো ঝরে, ফুল তো থাকে ফুটিতে...’। বুঝলাম, মা তাঁর মতো করেই কাঁদছেন।

সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়:

হ্যালো 70s,

বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.