|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩... |
পান্তাভাতে... |
গুলজার |
|
আমি আসলে এক জন বাঙালি, যে কিনা বাই চান্স জন্মে গিয়েছে পঞ্জাবি পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ আমায়, বা আমি রবি ঠাকুরকে পাকড়েছিলাম সেই ক্লাস এইট-এ। টেন পাশ করার আগে রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে ফেলেছি। মনে মনে তখনই ঠিক করেছিলাম, সাহিত্যিক হব। কলেজে পড়তে পড়তে আমায় পাঠিয়ে দেওয়া হল বম্বে, জীবনে যাতে কিছু করেকম্মে খেতে পারি, তাই ভেবেই বোধ হয়। । আমার বড় দাদা থাকতেন সেখানে। আমার ভারী লাভ হল। ক’দিনের মধ্যেই প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন, আই পি টি এ, এ সব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। সেখানকার লোকজন, চর্চা, বুদ্ধির শান, তর্কের উন্মাদনা আমায় নেশা ধরিয়ে দিল। আরও দুটো কাজ করলাম। এক, দাদার আস্তানা থেকে বেরিয়ে এলাম, ওঁর সঙ্গে আমার সাহিত্যিক মনের ঝঞ্ঝাট হল, আর দুই, নিজের পেট চালানোর জন্য মোটর গ্যারাজে কাজ নিলাম। আরও অনেক বাঙালি বন্ধুবান্ধব হল। বাংলা কবিতার প্রতি আরও আকৃষ্ট হলাম। ফাঁকা সময় পেলে জানলার ধারে বসে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা অনুবাদ করতাম।
আমার ঘরে থাকতে এল দেবু সেন। বিখ্যাত চিত্র-পরিচালক বিমল রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট। অবশ্য আমরা তখন সবাই আই পি টি এ-তুতো গুরুভাইও। আমি, দেবু, সলিলদা, রুমা গুহঠাকুরতা। দেবু বিমল রায় সম্পর্কে অনেক কথা বলত। ‘দ্য বিমল রায়’ সম্পর্কে তখন বম্বের আকাশ-বাতাস মুখরিত। আমার একটু বেশি শ্রদ্ধা বরাদ্দ ছিল ওঁর প্রতি, কারণ তাঁর সব সিনেমাই বাংলা সাহিত্যকে ভিত্তি করে। এক দিন দেবু এসে বলল, ‘কাল চলো, বিমলদার সঙ্গে দেখা করতে।’ প্রথমটায় আমি স্তম্ভিত, সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু দ্বিতীয়টায়, বললাম ‘না রে, আমি তো ফিল্মে কাজ করব না। তা হলে শুধু শুধু গিয়ে কী করব? আমি তো সাহিত্যিক হব।’ বকুনিটা খেলাম বিখ্যাত গীতিকার শৈলেন্দ্রর কাছে, ‘কী ভাবিস, যারা সিনেমায় কাজ করে, সবাই অশিক্ষিত? বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করবে বলে ঝালানি (বিমল রায়ের অন্যতম সহকারী) পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে বাংলা নিয়ে পড়েছে, বাংলা শিখেছে আর তুই কোনও পরিশ্রম ছাড়া একটা সুযোগ পাচ্ছিস, সেটা নিচ্ছিস না?’ আমায় যেতে হবে একটা গান লেখার কাজে, যেটা লেখার কথা ছিল শৈলেন্দ্রর। এস ডি বর্মনের সঙ্গে একটু মন-কষাকষি হওয়ায় সে লিখছে না। তাই আমি। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী। |
গেলাম। দেখি বিমল রায়ের মাথার পিছনে জ্যোতি-টোতি কিচ্ছু নেই, নেহাতই সরল-স্বাভাবিক লোক। অবাক হয়ে গেলাম। দেবু বলল, ‘বিমলদা, আমার বন্ধু গুলজার।’ বিমলদা বললেন, ‘হুঁ’। এই হচ্ছে বিমলদার সেই বিখ্যাত ‘হুঁ’। যার মানে যা খুশি হতে পারে। রেগে গেলেও ‘হুঁ’, খুশি হলেও একই ‘হুঁ’। এই হুঁ বুঝে আমরা সারা ক্ষণ আমাদের কাজের গতিপ্রকৃতি ঠিক করতাম। সে বড় কঠিন ব্যাপার ছিল। যাকগে, বিমলদা পরের বাক্যটা বললেন বাংলায়। দেবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই অবাঙালি ছেলেটা বৈষ্ণব কবিতা বুঝে লিখতে পারবে!’ দেবু থতমত, বলল ‘বিমলদা, গুলজার বাংলা বুঝতে পারে, বলতেও পারে।’ বিমলদা লজ্জায় লাল। সেই মুখটা আজও ভুলিনি।
গানটা নিয়ে শচীনদা আর বিমলদা এক দিন বসলেন। বিমলদা বলছেন, ‘বুঝলে, মেয়েটি কখনও ঘরের বাইরে বেরোয় না। তার বাবার কাছে লোকজন আসে, সেখানে বৈষ্ণব কবিতা পাঠ হয়। সেই শুনে মেয়েটি এই গানটা গাইতে অনুপ্রাণিত হয়।’ শচীনদা উত্তেজিত, ‘সে কী? মেয়েটা ঘরের বাইরে না বেরোলে কী করে হবে? আমি তো সে রকম সুর করিনি। না না, তুমি ওকে বলো ঘরের বাইরে বেরোতে।’ আমরা অবাক। বিমলদা বললেন, ‘বলো কী? আমি ক্যারেক্টারকে বলব, তুমি বাইরে যাও?’ শচীনদা বলছেন, ‘হ্যাঁ, ওকে পাঠিয়ে দাও।’ আর এক জন রাইটার ছিল, পল মহেন্দ্র, সে তখন বলল, ‘বিমলদা, মেয়েটা কী করে বাবার সামনে ঘরের মধ্যে রোম্যান্টিক গান গাইবে?’ শচীনদা হাতে তালি মেরে বললেন, ‘অ্যাই ত্তো’। দুজন বয়স্ক মানুষ খুঁতখুঁত করে প্রায় ঝগড়া করছেন একটা গানের সিকোয়েন্স নিয়ে, আমরা জুনিয়ররা শুনছি। এই খুঁতখুঁতটাই শেখার মতো। গানটা তৈরি হল ‘বন্দিনী’ সিনেমায়, নূতনজির লিপে, ‘মোরা গোরা অঙ্গ লই লে।’
বিমলদার ধারণা ছিল, উনি সং-সিকোয়েন্স নাকি ভাল তুলতে পারেন না। আর তাই গানের দৃশ্য তুলতে এত ডিটেলে কাজ করতেন, সেটা হয়ে উঠত অতুলনীয়। গানের মাঝখানে যদি কোনও বাজনা বদল হত বা নতুন কোনও বাজনা জুড়ত, তখনই বিমলদা বলতেন, ‘শট বদলাও, কী করে একই শটের মধ্যে লয় বা ইনস্ট্রুমেন্ট বদল হতে পারে?’ বিমলদার সিনেমায়, গানের মধ্যে অন্য শব্দও জোড়া হত। হয়তো দৃশ্যে কোথাও ঘণ্টা বেজে উঠল বা কুকুর ডেকে উঠল, সেটাও গানের সাউন্ডস্কেপে ধরা থাকত। অভাবনীয়!
এক বার, আমরা দু-শিফ্টে কাজ করছি বেশ কয়েক দিন। রাত দশটা নাগাদ কাজ শেষ হয়েছে। বাড়ি যাওয়ার তোড়জোড় করছি। এমন সময় বিমলদা ডাকলেন এডিটর মধুকরকে। বললেন, ‘তুমি গিয়ে এ বার ট্র্যাক বানাও।’ মধুকর রেগে কাঁই। ওঁর সামনে তো কিছু বলার সাহস নেই, গজগজ করতে লাগল, ‘এই লোকটার না নিজের কোনও জীবন আছে, না আমাদের কোনও জীবন রাখতে দেবে। বউকে আগেই বলে দিতাম, বাপু বিয়ে কোরো না, আমি বিমল রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট।’ তার পরেই বিমলদা আমায় ডেকে বললেন, ‘গোলজার’ হ্যাঁ ঠিক এই ‘বাঙালি’ উচ্চারণেই আমায় ডাকতেন ‘তুমি মধুকরকে সাহায্য করো।’ অগত্যা, বেজার মুখে আমরা কাজ করতে লাগলাম। রাত দুটো নাগাদ হঠাত্ একটা টেলিফোন এডিটিং রুমে। ও- প্রান্তে উত্তেজিত বিমলদা, ‘শোনো, এই ট্র্যাকে যেখানে টিকটিকির সাউন্ডটা আছে, ওখানটায় হোয়াইট পিস দিয়ে ছেড়ে দাও। আমি এখুনি টিকটিকির আওয়াজ রেকর্ড করেছি। দারুণ হয়েছে! কাল সকালে ওটা বসিয়ে দেব।’ তার মানে, আমরাই কেবল দু’শিফ্ট কাজ করার পরেও কাজ করছি না, বিমলদাও করছেন! আসলে, বিমলদা জীবনযাপন করতেন না, সিনেমাযাপন করতেন। |
|
|
|
|
|