চেনা গল্প অচেনা মোচড়
আজ কপাল পুড়ল: দুই বিঘা জমি-র
মাথায় ঠেকিয়ে, আম দুটোকে রাখবে বলে যেই ঝোলার কাছাকাছি এনেছে অমনি বাধা। শিববাবুর সেই মালিটা কোথা থেকে ছুটে এসে প্রবল চিত্‌কার শুরু করে দেয়। ওর বক্তব্য, বাবুর গাছকে কি উপেন নিজের গাছ ভেবেছে যে আম পড়া মাত্রই কুড়িয়ে নেবে! ‘বাবুর গাছ!’ হাসিই পায় উপেনের। এখন উপেন পুরী থেকে আসছে। ঝোলাতে পুরীর প্রসাদ রয়েছে। মালতীর জন্য আনা। উপেন ঝোলা হাতড়ে একটা প্যাড়া বের করে। একগাল হেসে বলে, ‘চেঁচাও কেন ভায়া নাও, একটু প্রসাদ নাও।’
নিজের গাছের আম দুটো ফেরত পেয়ে উপেনের পুরনো দিনের কথা মনে পড়তে থাকে। বড়লোক ও কোনও কালেই ছিল না। কিন্তু বউ-ছেলে ম্যালেরিয়ায় মারা যাওয়ার পরে ওর প্রয়োজন অনেকটাই কমে গিয়েছিল। কিছু দিন পরে একটা দায় অবশ্য তৈরি হয়েছিল। তবে মালতী কিছু নিতে চাইত না। নেবেই বা কেন? বাবুর বাড়ির ও খাস চাকরানি। খাওয়া-পরা তো ওখান থেকেই পেত। তার উপর বাবু লোকটা বজ্জাত হলেও, গিন্নিমা মানুষ ভাল। উপেনের তখন তাই এক রকম একারই সংসার। দু’বিঘে জমিতে ও কিছুটা সবজি লাগাত, কিছুটা ধান। এক পাশে ছিল ওর ছোট্ট কুঁড়েটা। যাকে ঘিরে ছিল বেশ কয়েকটা ফলগাছ। দিব্যি চলে যেত। সে সব দিনের পর নেই-নেই করে ষোলো বছর কেটে গেছে। মালতী বেঁচে আছে তো আবার! আশংকায় বুকটা কেঁপে ওঠে উপেনের।
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী।
নন্দীর গোলা, হাটখোলা পেরিয়ে রথতলায় এসে উপেন থামে। চারদিকে অনেক বাড়ি। কুঁড়েঘর আর নেই। সবই পাকা, নয় আধপাকা। এর মধ্যে কোনটা মালতীর? সৌভাগ্য, ঠিক লোকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়। বছর কুড়ির একটা ছেলে আসছিল রাস্তা দিয়ে। উপেন তাকে জিজ্ঞেস করতেই ওকে একেবারে একটা আধপাকা বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়ে সে হাজির করে। উঠোনে দাঁড়িয়ে ‘মা’ বলে হাঁক দেয়। ছেলের ডাকে মালতী বেরিয়ে উপেনকে ভাল ভাবে নিরীক্ষণ করে। ষোলো বছরের পরিবর্তনও কয়েক মুহূর্তের বেশি টেকে না। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে মালতী বলে ‘এত দিনে মনে পড়ল গোঁসাই!’
মান-অভিমানের পালা চলে অনেক ক্ষণ। মালতী বলে, ‘ছেলে কিন্তু জানে ওর বাবার পরিচয়। আমি সব বলেছি। লোকলজ্জার ভয়ে সে দিন আমরা কেউই সাহস দেখাতে পারিনি। না হলে বাবু যখন তোমার জমি কেড়ে সর্বস্বান্ত করল, তুমি তো আমার ঘরেই এসে উঠতে পারতে! মনের দুঃখে বৈরাগী হলে, ঘর ছাড়লে।’ ছেলে বলে, ‘এসেছ যখন আর তোমাকে কিন্তু ছাড়ছি না।’ ছেলে আবার বেরিয়ে যায়। একটু কি কর্কশ শোনাল ছেলের গলা? নইলে, এত চমত্‌কার একটা কথা, অথচ গলায় এক ফোঁটা আন্তরিকতা নেই কেন! অবশ্য ওকে কোনও কারণে বেশ চিন্তিতও মনে হচ্ছিল। তা সে যা হয় হোক। উপেন তো আর সত্যি সত্যিই থাকতে আসেনি। পুরীতে হঠাত্‌ এক দিন ভোরের স্বপ্নে চিন্তা এসেছিল অপঘাত নিয়ে। একটু ভাবিত না হয়ে পারেনি। আজ এসে সব দেখেশুনে ও যখন স্বস্তি পেয়েছে তখন তো মিটেই গেছে ব্যাপারটা। আর নতুন করে সংসারে জড়ানোর ইচ্ছে ওর নেই। দু’একটা দিনই হয়তো থাকবে। তার পর চলে যাবে।
বিকেলে বেড়াতে বেড়াতে নদীর ঘাটে এসে বসেছিল। এই জায়গাটা এখনও অনেকটা আগের মতোই আছে। বেশ একটু ফাঁকা ফাঁকা। তবে পারাপারের স্টিমারগুলো দেখতে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। একটা স্টিমার এসে লাগল ঘাটে। উপেন তাকিয়ে দেখে, যাত্রীদের মধ্যে সপরিবারে শিববাবু। পিছনে যথারীতি সেই দুলাল, নন্দ ইত্যাদি পারিষদের দল। শিববাবুর চেহারাটা আগের মতোই রয়েছে এবং চোখেমুখে সেই অহংকারটাও। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে ভাল লেগে গেল উপেনের। ও যখন যায় তখন বোধহয় এর বছর দুয়েক বয়স ছিল। এখন কত বড়! শিববাবুর মুখটা একেবারে বসানো। তবে স্বভাবে মনে হয় গিন্নিমার ধারা পেয়েছে। যে জন্য ওই চোখেমুখেও বেশ একটা মায়া জড়ানো ভাব।
উপেনের এক রকম পাশ দিয়েই চলে যায় সবাই। উপেনকে চেনার কোনও সম্ভাবনা নেই। ষোলো বছরে ওর চেহারা অনেকটাই বদলেছে। নানা জায়গা ঘুরে বেড়াবার কালেও কখনও মনে আসেনি, অথচ আজ শিববাবুকে দেখে উপেনের মনে হঠাত্‌ একটা প্রতিশোধের ভাব জাগে। সঙ্গে সঙ্গে হাসিও পায়। কেননা নিঃসম্বল মানুষের এ ইচ্ছের কোনও দাম নেই, তা ও ভাল ভাবেই জানে। সংসার ছেড়ে গোঁসাই হয়েছে, খুনখারাপি তো আর করতে পারবে না!
অন্ধকার হয়ে গেলেও জায়গাটা ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। রাত আর একটু বাড়লে নদীপাড়ের হেলানো বটের তলা থেকে ফিসফাস শব্দ ভেসে আসে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ের শরীরী অবয়ব আন্দাজ করা যায়। আর বসে থাকা ঠিক নয় ভেবে উঠতে যাবে, এমন সময় দুজনের কিছু কথাবার্তা ওকে দাঁড় করিয়ে দেয়। স্টিমার এ সময়ে নেই। তাতে কী! নৌকো তো আছে। দুজনের এক জন ওকে চিনবে না। কিন্তু অন্য জন অবশ্যই চিনবে। একেবারে টাটকা স্মৃতি। গায়ের উড়নিটা দিয়ে মাথায় পাগড়ি বাঁধে উপেন। তার পর দৌড়ে গিয়ে ঘাটের নৌকোটা খুলে ওদের মুখোমুখি এনে গলা পালটে বলে— ‘ও পারে যাবে তো এসো।’
ছেলেটা আর মেয়েটার কাছে এই মুহূর্তে আর কোনও বিকল্প নেই। মেয়েটাকে হাত ধরে বড় যত্নে নৌকোয় তোলে ছেলেটা। সঙ্গের ছোট্ট ব্যাগটা মেয়েটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলে রাখে। উপেন নৌকো ছাড়ে। দু’বিঘের পরিবর্তে বিশ্বনিখিল পাবার মনগড়া তৃপ্তি নয়, ওর ঠোঁটের কোণে যথার্থই তৃপ্তির হাসি। একটু আগে প্রতিশোধের কথা ভাবছিল, আশ্চর্য তখন কে ভেবেছিল...।
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে উপেন বলে, ‘শিববাবু তুমি আমার দু’বিঘে নিয়েছিলে, আজ দ্যাখো তোমার সর্বস্ব নিয়ে যাচ্ছে আমার ছেলে—’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.