প্রবন্ধ ১...
খেলা যখন খেলা নয়
খন সোভিয়েত জমানা। দশম শ্রেণিতে নতুন এক বিষয় পড়ানো শুরু হল: যৌনবিজ্ঞান। প্রথম দিনেই মাস্টারমশাই ক্লাসে এসে বললেন, ‘ছেলেমেয়ের মধ্যে ভালবাসার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক, আর এ ব্যাপারে তোমরা ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানো। আরও ভাল করে জেনে নেবার জন্য সামনের দিনগুলো তো পড়েই আছে। আর ছেলে-ছেলে, মেয়ে-মেয়েতে ভালবাসার বিষয়টি অস্বাভাবিক, বিকৃত, সুতরাং এ নিয়ে আলোচনা হবে না। তবে আরও দু’প্রকারের ভালবাসা আছে: পার্টির প্রতি জনগণের ভালবাসা আর জনগণের প্রতি পার্টির ভালবাসা। এই দুই প্রকারের ভালবাসা নিয়েই আমরা পুরো বছরটা আলোচনা করব।’
নেহাতই গল্প। সে কালের ফিচেল রসিকতা। এখন সেই সোভিয়েত নেই, কিন্তু যৌনতা, বিশেষত, ছেলে-ছেলে, মেয়ে-মেয়েতে বিষয়টি নিয়ে রাশিয়া দেশটি এখনও খবরের শিরোনামে। কিছু দিন আগে সে দেশে বিচিত্র এক আইন পাশ হয়েছে। সমকামিতা পুরোপুরি বেআইনি ঘোষিত না হলেও বলা হয়েছে, ঐতিহ্যবিরোধী, অপ্রচলিত যৌন সম্পর্ক বিষয়ে তথ্য দেওয়া বা এই বিষয়ে যে কোনও রকমের প্রচার সম্পূর্ণ বেআইনি। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর আওতা থেকে বাদ পড়বে না বিদেশিরা বা সংবাদমাধ্যমও।
বিপন্ন
এক কালে ‘উদারতা’র জন্য সোচি শহরটির সুখ্যাতি ছিল। আজ তা বিপন্ন। সেই শহরে
সমকামী অধিকার আন্দোলনের দুই কর্মী। অক্টোবর, ২০১৩। ছবি: রয়টার্স।
অথচ, মধ্যযুগের রাশিয়া সমকামিতা বিষয়টি নিয়ে ছিল উদারপন্থী। কিন্তু ১৭১৬ সালে দেশকে ‘আধুনিক’ করে তোলার উদ্যোগে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন জার পিটার দ্য গ্রেট। তিনি অবশ্য শুধুমাত্র সশস্ত্র সেনাবাহিনিতেই সমকামী সম্পর্ক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু এর পর সময় যত এগোয়, আইন বজ্রকঠিন হতে থাকে। চোখরাঙানো আইনে থাকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনও। তবে এ সমস্তই প্রযোজ্য ছিল শুধুমাত্র পুরুষের ক্ষেত্রেই। বলশেভিক বিপ্লবের পরে লেনিন জার আমলের এই সব আইনের আঁটুনি শিথিল করেন। যদিও, খেয়াল রাখতে হবে, রাশিয়া ছাড়া বাকি সোভিয়েতের সিংহভাগই কিন্তু জাঁতাকলে ফেঁসে রইল, ‘সংস্কৃতি’র দিক থেকে তারা ‘পিছিয়ে’ আছে বলে। স্তালিন ক্ষমতায় এসে এক আইন বলবত্‌ করলেন। আমাদের ৩৭৭ সদৃশ ধারা ১২১। গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নে। স্তালিনের এই একুশে আইন প্রীতির ঠিক কারণ আজও জানা নেই। হয়তো তিনি ভাবতেন, এ-সব ‘অভিজাত শ্রেণির অসুখ’, বা ফ্যাসিস্তদের মধ্যেই এই আচরণ দেখা যায়। হয়তো বা জন্মহার বাড়ানোর চিন্তাই এর কারণ। প্রসঙ্গত, এক ব্রিটিশ কমিউনিস্ট এই আইনের নিন্দে করে স্তালিনকে লম্বা চিঠি লেখেন। তখন কলম ধরেন ম্যাক্সিম গোর্কি। কড়া ভাষায় বলেন, দেশের যুবসম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এবং ফ্যাসিজমকে রুখতে এই আইন খুবই জরুরি, সমকামীদের সমূলে উপড়ে ফেললেই ফ্যাসিজম অদৃশ্য হবে। খেয়াল করবেন, এর বছরখানেক পরেই নাত্সিরাও সমকামিতাকে অপরাধ বলে ঘোষণা করে!
স্তালিন-পরবর্তী সময়ে, কয়েক দশকে নানা পথ পেরিয়ে অবশেষে ১৯৯৩ সালে ইয়েলত্সিন জমানায় একুশে আইনে বদল আসে, রাষ্ট্র জানায়, সমকামিতা আর অপরাধ নয়। যদিও নানা প্রশ্ন থেকেই যায়। ফিরে ফিরে আসতেই থাকে। এবং শেষ পর্যন্ত, কুড়ি কুড়ি বছরের পরে এখন আবার নতুন আইনে পুরনো রক্তচক্ষুর প্রত্যাবর্তন। এবং বিশেষ দ্রষ্টব্য আইনসভায় এই আইনের পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৩৬, বিপক্ষে ০! রাশিয়ার অর্থোডক্স চার্চ একে সাধুবাদ জানিয়েছে। স্বভাবতই। আর জনগণ? এক সমীক্ষায় নাকি নব্বই শতাংশ মানুষ এই আইনের পক্ষে রায় দিয়েছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ? শীতকালীন অলিম্পিক বসছে ফেব্রুয়ারিতে, রাশিয়ার সোচি’তে। অলিম্পিক বা এই স্তরের আন্তর্জাতিক আসর সব সময়ই রাজনৈতিক চাপানউতোর বা শক্তি প্রদর্শনের স্থান হয়ে দাঁড়ায়। সোচিও তার ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমা বিশ্ব এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করেছে। নানাবিধ হুমকি-তরজা চলছে এই আইন এবং সোচি অলিম্পিক ঘিরে। তার মাঝে আমেরিকা নিয়েছে এক অভিনব পন্থা। খেলার আসর তারা বয়কট করবে না। কিন্তু বার্তা দিয়েছে, তারা সোচিগামী এক্সপ্রেসে ঘোষিত সমকামী খেলোয়াড়দের তুলে দেবে। যাঁদের মধ্যে আছেন কিংবদন্তি টেনিস তারকা বিলি জিন কিং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকবেন তিনি। আর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে থাকবেন আইস হকি-র লেসবিয়ান তারকা কেটলিন কাহো। এ ছাড়াও দলে আছেন সমকামী অন্য খেলোয়াড়রাও। এবং, যাবেন না প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট বা ফার্স্ট লেডি। সোচিতে দেখা যাবে না জার্মানি বা ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধানদেরও। প্রেসিডেন্ট ওবামা স্পষ্টতই রাশিয়ার এই আইনকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবেই দেখছেন। অলিম্পিকগামী দল এমন ভাবে সাজিয়ে, ঘুরিয়ে নয়, সরাসরিই বার্তা পাঠালেন পুতিনের রাশিয়াকে।
কিন্তু ঘটনা কি এতই সহজ? প্যাঁচহীন? রাষ্ট্র আমেরিকা যখন মানুষের অধিকার নিয়ে বিষাদবিধুর হয়ে পড়ে, তখন পাপীতাপী মন হিসেব মেলাতে পারে না। এমনিতে বিশ্ব রাজনীতিতে এটা এমন এক সময় যখন ওবামা-পুতিনে এক ঘাটে বসে খোশগপ্পোর খোয়াব দেখার কথা নয়। সিরিয়া প্রসঙ্গে ওবামা এমনকী পুতিনের মূল্যবোধ নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, অথবা আমেরিকানদের রুশি শিশু দত্তক নেওয়া নিয়ে পুতিনের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞাকে মনে করা হচ্ছে রাশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের ওপর আমেরিকার বিবিধ নিষেধাজ্ঞার জবাব। এবং ভুললে চলবে না স্নোডেনের নাম। ভুললে চলবে না দুনিয়া জুড়ে মার্কিন নজরদারির বৈদ্যুতিন সাম্রাজ্যের কথা। মানুষের অধিকার রক্ষা করতে হলে জনজীবনে নজর রাখতেই হবে, তা সে প্রকাশ্যেই হোক বা তস্করসম! নিশ্চিত ভাবেই, তাল ঠোকাঠুকির এই সব নানা তরজায়, রাজায় রাজায় কোঁদল পাকানোয় আর একটি প্রশ্ন হয়ে ওঠে এলজিবিটি অধিকার।
কিন্তু, শুধু কি এই? দুই দেশের চাপানউতোর বা মানবাধিকার নিয়ে মাথার যন্ত্রণা? না, তার সঙ্গে আছে বাণিজ্য-বেড়াল, ঝুলি থেকে সে-ও বেরিয়ে পড়েছে। পিঙ্ক মানি, পিঙ্ক ডলার বা পিঙ্ক পাউন্ড। অর্থাত্‌, এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতা। ব্রিটেনের বাজারে বছরে প্রায় ছয় বিলিয়ন পাউন্ড, আমেরিকায় সাতশো নব্বই বিলিয়ন ডলার। এবং সে থেমে নেই, রীতিমত শোর তুলেছে: দেখো আমি বাড়ছি মামি। পুঁজি কি সন্ন্যাস নিয়েছে যে এই বিরাট বাজার সে হাতছাড়া করবে? হয়তো সব ভালর জন্যই। বিশ্বের দুই শক্তির ঠান্ডা লড়াই যদি ‘পারমাণবিক’ থেকে ‘মানবিক’ তরজায় উত্তীর্ণ হয়, তা কাম্যই। কিন্তু তর্কটার এতগুলো স্তর ও ঘাঁতঘোঁত, চট করে হাততালি দেওয়া উচিত নয়। পুতিন যা করছেন, খুব খারাপ। কিন্তু সেটাকে ওয়াশিংটন নিজের কূটনীতির স্বার্থে খানিকটা কাজে লাগিয়ে নিল, এতে রাশিয়ার সমকামী বা স্বাধীনতাকামী মানুষের আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদেরও না। নিজেদের লড়াই নিজেদেরই লড়তে হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.