সাহিত্য সম্মেলনের টানে দশ হাজার বাঙালির তিন রাতের সহাবস্থান। কলকাতা, দিল্লি,
মুম্বই থেকে নাগাল্যান্ডের শেষ প্রান্ত। বাদ নেই আন্দামানও। লিখছেন বিপ্লবকুমার ঘোষ |
ত্রিবেণীসঙ্গম ছাড়িয়ে ইলাহাবাদের গঙ্গার চর বরাবর এখনও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কুম্ভমেলার বহু চিহ্ন। এখনও মোছেনি স্মৃতি। ফের গঙ্গার অন্য প্রান্তে সম্প্রতি আয়োজিত হল আর এক মিনি কুম্ভমেলা। তবে এই মেলায় বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ আসেননি। এসেছেন শুধুমাত্র বাংলা ভাষার মানুষ। পরনিন্দা, পরচর্চা, পরশ্রীকাতরতা কাটিয়ে দশ হাজার বাঙালির তিন রাতের সহাবস্থান। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই থেকে নাগাল্যান্ডের শেষ প্রান্ত। বাদ নেই আন্দামানও। ট্রেনে বাসে বা বিমানে এসেছিলেন ওঁরা। টানটান নিরাপত্তায় শহর জুড়ে পুলিশি টহল। আকাশে মাঝে-মধ্যে হেলিকপ্টারের চক্কর। তার কারণ, বছরের শেষ প্রান্তে ‘বাঙালিয়ানার এই একতা’য় সিলমোহর দিয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ছিয়াশিতম অধিবেশনে তিনি অংশ নিলেন শুধু নয়, প্রদীপ জ্বালিয়ে শুভ সূচনাও করে দিয়ে গেলেন। বললেন, ‘সাহিত্য থেকেই আসে সংহতি।’
উপলক্ষ সাহিত্য। আর সেই সাহিত্য ঘিরেই এক শ্রেণির কবি ও লেখকের নতুন করে জেগে ওঠার ইচ্ছা। কে বলে বাঙালির ইচ্ছেশক্তি নেই? হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় রাতের শেষ অধিবেশনে হালিশহর বা বধর্মানের কোনও কবি বা লেখক শোনাচ্ছেন তাঁর প্রতিভার শেষ অস্ত্র, বাহবার ফুলঝুরি ছুটছে। পাশাপাশি কলকাতার কোনও বিখ্যাত লেখক বা সাংবাদিকের দিকে ছুটে আসছে প্রশ্নবাণ: ‘বড় কাগজে আমরা ঠাঁই পাই না কেন?’ উত্তেজিত হওয়া বাঙালির স্ব-ভাব। লখনউতে তিন বছর আগে এমনই এক বাঙালি সম্মেলনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বেশ চড়া সুরে প্রশ্ন করেছিলেন স্থানীয় কয়েক জন কবি। সুনীলদা অমায়িক হেসে এড়িয়ে গেলেন। কিন্তু কেন? রাতে কৌতূহল চাপতে পারিনি। অতিথিশালায় ফের ওই প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি সহাস্য উত্তর দিলেন, ‘আরে ওরা অনেকেই ব্যর্থ লেখক, ব্যর্থ কবি। ওরা ওদের ক্ষোভ তো জানাবেই।’ |
এ বারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কলকাতার বড় লেখকদের দিকে তাকিয়ে থাকা একটা বড় ভিড় লেগেই আছে। সারা বছর সাহিত্য-সৃষ্টির পর তা ছাপার অক্ষরে সাজিয়ে নিয়ে অনেকেই চলে এসেছেন ঝোলা-ভর্তি ‘সৌজন্য সংখ্যা’ বিলিয়ে দিতে। নজর কাড়তে। একটি ঝাঁ-চকচকে সংখ্যা নেড়ে-চেড়ে দেখছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তত ক্ষণে পাহাড়প্রমাণ সৌজন্য সংখ্যায় তিনি বেশ কাহিল।
গত কয়েক বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমনই সব প্রবাসী বাঙালির উত্সবে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত থেকেছি। চমকে উঠেছি এমন কিছু মানুষ দেখে যাঁরা তিন মাস আগে ট্রেনের টিকিট রিজার্ভ করে পুরো পরিবার নিয়ে সাহিত্য সম্মেলনে চলে এসেছেন। কাকভোরে উঠে ভিন রাজ্যের রাজপথে শোভাযাত্রায় প্রবল উত্সাহ আর আগ্রহ নিয়ে পা মিলিয়েছেন। কয়েক কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ক্লান্ত হয়ে অন্য বাঙালিদের সঙ্গে সহমর্মিতার গল্প বলছেন।
প্রশ্ন একটাই, দিনকে দিন ভিন রাজ্যের এই সব বাংলা উত্সবে ভিড় বাড়ছে শুধু মাত্র সাহিত্যকে ভালবেসেই? না মানছেন নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের মুখ্য সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষ বা লখনউয়ের ‘লখনউ উত্সব’-এর কর্ণধার অমলেন্দু দত্ত। তাঁদের মতে, ভিড় বাড়ার কারণ প্রথমত, বাড়ির বাইরে বেরোনো, বেড়ানো, দ্বিতীয়ত, সাহিত্যসভার পরে কলকাতা দিল্লি মুম্বইয়ের শিল্পীদের গান ও আবৃত্তি শোনা। থাকা ও খাওয়ার ঝামেলা নেই। কম খরচে আপ্যায়নেরও ত্রুটি নেই। এবং সঙ্গে আছে একটা অদ্ভুত আন্তরিকতার স্পর্শ।
কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে আছে দুর্মর আকাঙ্ক্ষা, সতেজ স্বপ্ন, অমলিন প্রত্যয়। কানপুরের কবি বরেন সরকার বা অসমের নীলাদ্রি বিশ্বাসরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের প্রতিভা এক দিন ঠিক মূল্য পাবে। কানপুর থেকে বাপি চক্রবর্তী, নাগাল্যান্ড থেকে অরূপ মৈত্র, বেনারস থেকে বাবলু সরকার তাই তাঁদের ত্রৈমাসিক লিটল ম্যাগ নিয়ে নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে চলে আসছেন কলকাতার আসন্ন বইমেলাতেও। মানুষের ভিড়ে, বইয়ের চাপে তাঁদের খুঁজে পাবেনই বা ক’জন? কিন্তু চলে যাবার সময় তাঁদের আত্মোপলব্ধি তো হবেই, ‘এত বাঙালির ভিড়ে আমিও তো হারিয়ে যাইনি।’
বাংলার বাইরে এই যে এত সাহিত্য বা সম্মেলনের আয়োজন তার একটা নিজস্ব চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য কি নেই? অন্য ভাষার ভিড়ে নিজের ভাষাকে না হারাবার একটা তাগিদ কি তাড়া করে বেড়ায় না প্রবাসী বাঙালিদের? হর্ষ দত্ত একমত, বললেন, “আমরা বাংলায় বসে এর অন্তর্নিহিত আবেদন ও গুরুত্ব অতটা বুঝতে পারব না। সাহিত্যের প্রতি এদের ভালবাসা যে কত গভীর, ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রকাশিত বাংলা পত্র-পত্রিকার সংখ্যা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। শুধু সংখ্যার বিচারেই নয়, পত্রিকাগুলির গুণমান ও আন্তরিকতা আমাদের বিস্মিত করে।” এবং তিনি ঠিক এখানেই একটা আশার আলোও দেখতে পান, বলেন, “এক দিন এই প্ল্যাটফর্ম থেকেই কেউ উঠে এসে চমকে দেবে আমাদের।” |