পুরাকালের সকল লেখককেই আমরা ঋষি বা দ্রষ্টার আসন দিয়া থাকি। বৈঠকী তর্কে প্রায়ই শুনা যায়, ব্যাসদেব মিসাইলের কথা ভাবিয়াই একাঘ্নী অস্ত্রের কথা লিখিয়াছিলেন, বাল্মীকি পুষ্পক রথ বলিতে জেট-বিমান ব্যতীত আর কিছুই বুঝান নাই। ঈশপের গল্পগুলিকে মহাকাব্যের তুল্য আলোচনার স্থান দেওয়া হয় না, কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাইল, তিনিও নির্ভুল ভাবে ভবিষ্যত্ বলিয়া দিয়াছিলেন। সম্প্রতি চিন-এ অনুষ্ঠিত এক অভিনব প্রতিযোগিতায়, পোষ্য জন্তু বা পাখি এবং তাহাদের প্রভুগণ একযোগে স্কি করিলেন (পোষ্যটি স্কি-র উপর স্থিত বা চেন দিয়া বাঁধা), এবং একটি খরগোশ একটি কচ্ছপের নিকট পরাজয় বরণ করিল। বিখ্যাত গল্পটি পড়িবার সময় নিশ্চয় অনেকের মনে হইয়াছিল, নীতিবাক্য বলিবার নিমিত্ত এটি এক চমত্কার নির্মাণ, কিন্তু বাস্তবে এমন প্রতিযোগিতা হইলে খরগোশ অবশ্যই জিতিবে। কিন্তু দেখা যাইল, খরগোশ বাস্তবিকই ‘স্টেডি’ নহে। কাহিনিটিতে সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, আর এই বরফ-দৌড়টিতে খরগোশটি লাফাইয়া লাফাইয়া বিভিন্ন স্থানে যাইতে এবং সব কিছু দেখিতে এমন ব্যস্ত ছিল, সে লক্ষ্যরেখাটির প্রতি মনোযোগী হয় নাই। বিখ্যাত খরগোশ কার্টুন-চরিত্র ‘বাগ্স বানি’র এক চলচ্ছবিতেও, ঈশপানুযায়ী দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন হইয়াছিল। প্রতিযোগী কচ্ছপ ‘সিসিল’ রেস-পথ নিবাসী তাহার সকল ভ্রাতাকে এক ফন্দি শিখাইয়া দিয়াছিল। বাগ্স বানি যতই দ্রুত ছুটিতে থাকে, প্রতিটি বাঁক ঘুরিয়াই সে আবিষ্কার করে কচ্ছপ তাহার সম্মুখে গুটিগুটি হাঁটিতেছে (খরগোশের দৃষ্টিতে, সকল কচ্ছপ একই রকম দেখিতে)। অন্তিম লাইন অতিক্রম করিয়া সে দেখে, সিসিল বহু পূর্বেই পৌঁছাইয়া তাহার প্রতীক্ষা করিতেছে। তাহার ক্ষতস্থানে লবণ ছড়াইয়া সিসিল প্রশ্ন করে, ‘এত বিলম্ব হইল কেন?’ খরগোশগণ যদি সংবাদপত্র পাঠ করে, তাহারা চিনের এই ঘটনায় আরও ক্ষিপ্ত ও অধোবদন হইবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্ন হইল, প্রকৃত জয়ী কে। বৃক্ষশাখে কাষ্ঠের বিহঙ্গ রাখিয়া দ্রোণাচার্য ছাত্রদের প্রশ্ন করিয়াছিলেন, কী দেখিতেছ। অর্জুন ‘কেবল বিহঙ্গের চক্ষু দেখিতে পাইতেছি’ বলিয়া বাহবা কুড়াইয়াছিলেন, তাঁহার তীক্ষ্ন মনোযোগ ও ধ্যান প্রশংসিত হইয়াছিল। যুধিষ্ঠির বলিয়াছিলেন, তিনি চতুষ্পার্শ্বের সকলই দেখিতে পাইতেছেন এবং তিরস্কৃত হইয়াছিলেন। এক পণ্ডিত বিশ্লেষক কিন্তু আমাদের শিখাইয়াছেন, যুধিষ্ঠির যে কোনও বস্তু বা ঘটনাকে তাহার সমগ্রতার প্রেক্ষিতে দেখিতে সচেষ্ট ও অভ্যস্ত ছিলেন, তিনি কোনও অংশকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখিবার শিক্ষায় বিশ্বাসী নহেন। কারণ বৃক্ষ আকাশ মাটির অঙ্গ হিসাবে বিহঙ্গকে দেখিলে তবেই এই বৃহত্ ও বহুস্তর জীবনকে বুঝিবার পথে অগ্রসর হওয়া যায়। তাই যোদ্ধা হিসাবে অর্জুন শ্রেয় হইলেও, দ্রষ্টা হিসাবে যুধিষ্ঠির বহু গুণ প্রণম্য। এই দৌড়ে খরগোশটি তাহার দৌড়পথের নানা স্থান দেখিতে ও সেই সকল দৃশ্য উপভোগ করিতে ব্যস্ত ছিল। অর্থাত্, তাহার নিকট কেবল শেষ বিন্দুটি গুরুত্বপূর্ণ নহে, সমগ্র যাত্রাপথটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ। সে কেবল জয়ের ট্রফিটি লইয়া আনন্দ করিতে আসে নাই, দৌড়ের আনন্দকে রেণু-রেণু অনুভব করিতে আসিয়াছে। ঈশপের গল্পেও তাহার যখন নিদ্রাকর্ষণ হইয়াছিল, সে দিব্য ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সে শ্রদ্ধা করিতে জানে, প্রতিটি কণা হইতে সে পূর্ণ পরিমাণ রস দোহন করিয়া লয়। তাহার ইচ্ছা অনুযায়ী সে চলে ও থামে, দৌড়ায় ও হাঁটে, কোনও লক্ষ্য বা কীর্তির দাবির নিকট সে নিজ স্বাধীনতাকে বিক্রয় করে নাই। কচ্ছপ হয়তো স্বীকৃতি পাইতেছে বিস্তর, কিন্তু খরগোশ আস্বাদন করিতেছে বিশাল বিশ্বের অতুলন সম্ভার। সাফল্যের প্রচলিত ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া, কল্পনা ও বাস্তবে অন্যকে অনায়াসে নায়কের স্থান ছাড়িয়া দিয়া, সে নিজেকে আদর করিতে শিখিয়াছে। নিজ আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করিতে শিখিয়াছে। সেইখানে তাহার জয়। |