|
|
|
|
ঝোপে ঢুকে প্রাণ বাঁচালেন বাস চালক
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ভাগ্যিস ঝোপটা ছিল! অসমের কোকরাঝাড়ে জঙ্গিদের বন্দুকের গুলি থেকে বাঁচতে শুক্রবার রাতভর সেখানেই লুকিয়ে ছিলেন বিহারের ছাপরার বান্দ্রা গ্রামের বাসিন্দা অখিলেশ সিংহ। কাজের খোঁজে অরুণাচলে যাচ্ছিলেন দাদা পাপ্পুকে সঙ্গে নিয়ে। বছর তেইশের অখিলেশ বাঁচলেও, বাঁচেননি তাঁর দাদা পাপ্পুকুমার সিংহ (২৫)।
পুলিশ সূত্রের খবর কোকরাঝাড়ে ওই হামলার সময় বাস থেকে ১২ জনকে নামতে বাধ্য করেছিল জঙ্গিরা। তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় পাঁচ জনের। গুরুতর জখম হন তিন জন। তাঁদের মধ্যে এক জন মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জের কোহেতপুর গ্রামের বাসিন্দা বাবুলাল কর্মকার। অন্যদের মধ্যে অখিলেশ ঝোপে লুকিয়ে বেঁচে গিয়েছেন। বাকি তিন জনের মধ্যে দু’জন নিখোঁজ। শনিবার সন্ধ্যায় অসমের গোঁসাইগাঁও স্টেশনের কাছে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ছাপরার বাসিন্দা আর এক বাসযাত্রী বিকাশ রায়কে।
বাসে হামলার আতঙ্কের রেশ কাটতে না কাটতেই এ দিন ফের কোকরাঝাড়ে এক ব্যক্তিকে খুন করল জঙ্গিরা। শনিবার উদালগুড়ি থানার অম্বাগাঁও এলাকায় ওই হামলায় মৃত্যু হয় বিহারের বাসিন্দা বিক্রম সিংহের (৫৫)। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, পেশায় নাপিত ওই ব্যক্তি তাঁর সেলুন থেকে ফিরছিলেন। পথেই তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। অসমের চিরাঙে আর এক জঙ্গি-হামলায় মারা যান এক জন, জখম হন চার জন। দু’টি ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত বড়ো জঙ্গি গোষ্ঠী এনডিএফবি।
পুলিশ জানায়, শুক্রবারের হামলায় নিহতদের মধ্যে ছাপরার রামপুর গ্রামের বাসিন্দা দুই ভাই রাজবিহারি গিরি (২৯), আহদ গিরি (৩০) ও ছাপরার ধর্মস্থান গ্রামের বাসিন্দা সমেশ্বর মন্ত্রী (৩৫) রয়েছেন। এক নিহত যাত্রীর পরিচয় জানা যায়নি। বাবুলাল-সহ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তিন জন।
কী হয়েছিল শুক্রবার রাতে?
একটি ধাবায় যাত্রীদের খাওয়ার পরে একসঙ্গে চারটি দূরপাল্লার বাস শিলং, লখিমপুর-সহ অসমের অন্য গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ জঙ্গলপথে জলপাই রঙের উর্দি পরা অন্তত ১০ জনের একটি দল রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে বাস থামাতে বলে। সকলেরই মুখ ছিল বাঁধা। তাদের দেখে ফৌজি ভেবে নির্জন জঙ্গলের মধ্যে বাসগুলি থামিয়েছিলেন চালকেরা। রাস্তার কিছুটা দূরে গাছের ডালও ফেলে রাখা ছিল। শিলিগুড়ি থেকে লখিমপুরগামী ‘স্বপ্না’ নামের বাসটিতে এক জন উঠে, দরজা খুলে চালককে টেনে নামিয়ে, তার পরিচয় জানতে চান। পরিচয় জেনে, তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ‘ভাগো ইঁহাসে।’ বাস থেকে নামানো ১২ জন যাত্রীকে পিছন ফিরে ছুটতে বলে নির্বিচারে গুলি চালায় তারা।
অখিলেশের কথায়, “২-৩ মিনিট ধরে গুলি চালায় ওরা। আমি রাস্তার পাশে গড়িয়ে পড়েই অন্ধকারে দৌড় লাগাই। কোনওমতে একটা নদীর পাশের ঝোপে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলাম। রাতভর লুকিয়ে ছিলাম সেখানেই। সকালে দাদার মোবাইলে ফোন করি। এক পুলিশ অফিসার ফোন ধরে থানায় আসতে বলেন। গিয়ে দেখি দাদাকে ওরা মেরে ফেলেছে।” যে বাসের যাত্রীদের নামানো হয়েছিল তার চালক সেরফাংগুড়ি থানায় যান। সেখানে রাতভর থাকার পরে শনিবার সকাল ১০টা নাগাদ ফের লখিমপুরের দিকে রওনা হয় বাসটি। ওই বাসের মালিক বিনায়ক পাঠক বলেন, “এর পরে বাস চালানো নিরাপদ হবে কি না বুঝতে পারছি না।” যে সংস্থার হয়ে বাসটি চলাচল করে তাদের বাপ্পা ভৌমিক বলেন, “নিরাপত্তা রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ করা না হলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।”
শুক্রবার রাতে কী ভাবে বাস যাত্রীদের হত্যা করা হয়েছে, বাসের চালকদের থেকে তা শোনার পরে শিলিগুড়ি থেকে অসম-মেঘালয় রুটের গাড়ির চালক-মালিকেরা শঙ্কিত। বাস মালিক-কর্মীদের সংগঠন অসম, মেঘালয় রুটে বাস চালানো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ‘দার্জিলিং জেলা অসম বাস ওনার্স অ্যান্ড বুকিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি বাচ্চু দত্ত বলেন, “গত ৩০ বছর ধরে অসমে বাস চালাচ্ছি। এমন ঘটনা কোনও দিন ঘটেনি। ঘটনার পরেও নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই অসম-মেঘালয় রুটে বাস চালানো বন্ধের কথা ভাবতে হচ্ছে।”
ঘটনা হল, শুক্রবার কেএলও-র ডাকা ২৪ ঘণ্টার বন্ধের জন্য উত্তরবঙ্গ ও নমনি অসমে বিশেষ সতর্কতা জারি থাকার কথা। উত্তরবঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন রাতভর নজরদারি চালিয়েছে। কিন্তু, কোকরাঝাড়ে কনভয় বা নিরাপত্তা ছাড়া কেন যাত্রীবাহী ওই বাসগুলিকে পুলিশ যেতে দিল কেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অসমের পরিবহণমন্ত্রী চন্দন ব্রহ্ম মেনে নেন, প্রশাসনের তরফে নিরাপত্তায় খামতি ছিল। সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ, ঘটনায় জড়িত জঙ্গিদের ধরতে তীব্র অভিযান চালাবার জন্য ডিজি খগেন শর্মাকে নির্দেশ দেন।
জঙ্গিদের গুলিতে স্বামীর আহত হওয়ার খবর শুক্রবার গভীর রাতে পান বাবুলাল কর্মকারের স্ত্রী শকুন্তলা। দিনমজুর বাবুলালের আয়েই কোনও মতে চলে সংসার। বড় ছেলে দীপক ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। দিবস এ বার পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে। শকুন্তলাদেবী বলেন, ‘‘এর আগেও আমার স্বামী কাজের জন্য ওড়িশা ও পুণেতে গিয়েছে। কিন্তু অসমে এই প্রথম। দিনমজুর হিসেবে গ্রাম থেকে অনেকেই যায়। এ বারেও বাইরে যাওয়াতে আপত্তি করিনি।”
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে শনিবার অসমে রওনা হন বাবুলালবাবুর দুই আত্মীয়। ১২ বছরের দীপক শুনেছে বাবাকে গুলি করেছে কেউ। কিন্তু কারণ জানে না। তার জিজ্ঞাসা, “বাবার কাছে তো একশো টাকাও নেই। তা হলে বাবাকে ওরা গুলি করল কেন? বাবা বলেছিল এক সপ্তাহ পরেই বই কেনার টাকা পাঠাবে। বাবা বাঁচবে তো?’’ |
|
|
|
|
|