উত্তমজেঠু আমার অভিনয় জীবনের প্রথম অভিভাবক। ওঁর কাছে বড় কৃতজ্ঞ আমি। ওঁর হঠাৎ চলে যাওয়াটা আমাকে অভিভাবকহীন করে দিয়েছিল। তবে হ্যাঁ, সৌমিত্রকাকুও সব সময়ে আমার পাশে ছিলেন। কিন্তু যদি মিসেস সেনের কথা ভাবি? স্মৃতি বলতে আমার সম্বল শুধু একটা ফোটো। যে ছবিতে ‘ছোট্ট জিজ্ঞাসা’র সেটে তখনকার ছোট্ট প্রসেনজিতের গালে চুমু দিচ্ছেন মহানায়িকা। সেই শেষ! আর তো পাইনি ওঁকে। এই নিয়ে বহু দিন ধরেই একটা আক্ষেপ রয়েছে আমার। উনি ইন্ডাস্ট্রি থেকে একেবারে সরে গিয়েছেন বলে নয়, ওঁকে কখনও আমাদের অভিভাবক হিসেবে পেলাম না বলে। উত্তমজেঠুর মতোই ওঁকেও পাশে চেয়েছিলাম, প্রতি পদে ওঁর পরামর্শ পেতে চেয়েছিলাম। তবে আমরা সবাই ওঁর এই আড়ালে থাকাটাকে সম্মান করেছি। সেলাম করেছি ওঁর এই সিদ্ধান্তকে।
না, মিসেস সেনের কোনও পরামর্শ বা টিপ্স সরাসরি পাইনি আমি। তবে বাবার কাছেই শোনা একটা গল্প, সেটাই আমার জীবনে পরোক্ষে ওঁর থেকে পাওয়া বিরাট পরামর্শ। বাবা তখন সবে পা রেখেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। ‘হসপিটাল’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয়ের অফার এল। মিসেস সেন তখন তাঁর কেরিয়ারের শীর্ষে। একটা দৃশ্য ছিল যেখানে বাবা বলবেন, ওঁকে কতটা ভালবাসেন এবং সুচিত্রা সটান প্রত্যাখ্যান করে বলবেন, এ সম্পর্ক হতে পারে না। পরের দৃশ্যে বাবা শক্ত করে ধরবেন সুচিত্রার হাত। বুঝিয়ে দিতে চাইবেন তাঁর ভালবাসা কতখানি এবং এ সম্পর্ক সফল হতেই পারে। কিন্তু বাবা এতটাই নার্ভাস যে, কিছুতেই হাতটা ধরে উঠতে পারছেন না! শেষমেশ মিসেস সেনই বাবাকে ডাকলেন। বোঝালেন, এই মুহূর্তটার জন্য ভুলে যাও, তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো। ভাবো, তুমি তোমার প্রেমিকার সামনে দাঁড়িয়ে। ওকেই বোঝাচ্ছো নিজের ভালবাসার কথা। শটটা দেওয়ার পর দেখা গেল কাচের চুড়ি আটকে রয়েছে মিসেস সেনের হাতে। গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। সুচিত্রা অবশ্য নির্বিকার। বাবাকে বলেছিলেন, “গুড শট অ্যান্ড প্যাক আপ।” বাবার কাছে শোনা এই গল্পটাই আমার কাছে সুচিত্রা সেনের পরামর্শ। আমিও তাই সব সময়ে আমার জুনিয়রদের সঙ্গে খুব খোলাখুলি মিশি। ওদের জড়তা কাটিয়ে অভিনয় করতে সাহায্য করি। |
হলে গিয়ে ওঁর কোন ছবি প্রথম দেখেছিলাম, মনে পড়ছে না এখন। তবে টিভিতে দেখা প্রথম ছবি ‘উত্তরফাল্গুনী’। এ ছবি দেখেই প্রথম বুঝেছিলাম, সুচিত্রা সেন কে। একটা সময় ছিল যখন আমি, শুধু আমি কেন, সকলেই টিভির সামনে বসে পড়ত উত্তম জেঠু আর মিসেস সেনের ক্লাসিক ছবিগুলোর টানে। ওই ছবিগুলো গিলেছি-টা বোধহয় সঠিক শব্দ! রিনা ব্রাউন সে সময়কার কত ছেলের ড্রিমগার্ল। বাজি রেখে বলতে পারি, এই প্রজন্মের বহু ছেলের কাছেও তিনি ড্রিমগার্লই।
মিসেস সেনের সঙ্গে অভিনয় করার সুযোগ তো আর হয়নি। তবে মুনমুন এবং পরে রাইমা-রিয়া সবার সঙ্গেই কাজ করেছি। রাইমার সঙ্গে যখন ‘চোখের বালি’ করি, ওর মুখেই শুনেছিলাম, মিসেস সেন গোটা ছবিটা খুঁটিয়ে দেখেছেন। আমার কাজও ওঁর ভাল লেগেছে। একই কথা ‘নৌকাডুবি’ সম্পর্কেও প্রযোজ্য। ওতে রাইমা-রিয়া দু’বোনই ছিল। তাই ছবিটা ওদের দিদার কেমন লেগেছে, জানার ইচ্ছে ছিল খুব। তখনও শুনেছি আমার অভিনয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন উনি। ওঁর প্রশংসাই আমার কাছে অনেকখানি।
কৃষ্ণা দাশগুপ্ত সাধারণ মেয়ে থেকে মহানায়িকা। বিয়ের পর অভিনয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তা তাঁর কেরিয়ারে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। সত্যজিৎ রায়ের ইচ্ছা ছিল ‘দেবী চৌধুরাণী’ করার। ডেটের সমস্যায় সুচিত্রা সময় দিতে পারেননি। ছবিটা হলে নিশ্চিত ভাবে আর একটা মাইলফলক হতো। |