তখন কলেজে পড়ি। এন টি ওয়ান স্টুডিওতে এক দিন আমি শ্যুটিং সেটে ঢুকে পড়েছিলাম। একটু পরেই ম্যাডাম ঢুকলেন। প্যান্ট আর টপ পরে। এ দিক-ও দিক তাকিয়ে গটগট করে এগিয়ে গেলেন। কিছু পরেই ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট দৌড়ে এসে বলল, “বেরোও ভাই এখান থেকে।”
আমি যখন কলকাতার পুলিশ কমিশনার, তখন ‘সানন্দা’য় একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলাম ঘটনাটা। এর কয়েক মাস পরে লালবাজারে তখনকার ডেপুটি মেয়র মণি সান্যালের সঙ্গে একটা মিটিং করছি। হঠাৎ একটা ফোন। উল্টো দিকে এক মহিলা। ধরলাম, কিন্তু কোনও কথাই বলছেন না। সামান্য কড়া ভাবে বললাম, “আপনার কি কিছু বলার নেই? তা হলে ফোন ছেড়ে দিচ্ছি।” মহিলা তখন হাসলেন। সুচিত্রা সেনের যে কোনও ভক্ত জানেন, অবিস্মরণীয় সেই হাসি। আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “আপনি কে বলুন তো?” উনি বললেন, “আমি মিসেস সেন।” আমি বললাম, “মিসেস সেন মানে?” আবার সেই হাসি। আমি বেশ কনফিউজড। বললাম, “মিটিংয়ে আছি। আপনার নম্বরটা দিন। আমি পরে ফোন ব্যাক করছি।” |
ভাবলাম, সত্যিই ইনি সুচিত্রা সেন? নাকি হেঁয়ালি? অনেক ভেবেটেবে নম্বরটা রেখে দিলাম। কল ব্যাক করিনি।
কয়েক দিন বাদে উনি ‘সুচিত্রা সেন’ পরিচয়েই ফোন করলেন। বললেন, “শুনুন কমিশনার সাহেব, ভারী বিপদ হয়েছে আমার। এক মহিলা রিপোর্টার বাড়ির গেট টপকে ঢুকে পড়েছে। আপনি শিগগিরি একটা ব্যবস্থা করুন।” আমি তখন ওসি বালিগঞ্জকে ফোন করে বললাম, শিগগির মহিলা পুলিশ নিয়ে যাও। সে যাত্রা ঝামেলা মিটল।
সে দিন সন্ধেতেই মিসেস সেন ফোন করে বললেন, “আজ প্লিজ আমার এখানে এক কাপ চা খেয়ে যাবেন।” গিয়েছিলাম। তখন অন্য মানুষ। নিজের হাতে চা আনছেন। হাসি-মস্করা করছেন। কিন্তু যা নিয়ে মন্তব্য করবেন না বলে ঠিক করেছেন, সেটা কিছুতেই মুখ দিয়ে বেরোবে না। যেমন আমি বললাম, “ঋত্বিক ঘটকের কাছে শুনেছি, ওঁর ট্রিটমেন্টের সময়ে আপনি অনেক সাহায্য করেছেন।” উনি কিছু বললেন না। আমি বললাম, “ঋত্বিকদা এ-ও বলেছিলেন যে ‘রেজারেকশন’-এর ধাঁচে একটি ছবি ওঁর করার কথা ছিল। আপনি আর উত্তমকুমার তাতে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি।” উনি আবার চুপ।
সালটা ১৯৯৪। সুচিত্রা তখন ষাটোর্ধ্ব। কিন্তু সৌন্দর্যের একটা শেষ ছটা তখনও ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনি সত্যিই সত্যজিৎ রায়কে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন?” উনি হেসে বললেন, “আরে মশাই, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?” আমার প্রশ্নের ঝাঁপি তখনও শেষ হয়নি। বললাম, “ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এক বার আপনাকে বোরখা পরা অবস্থায় দেখেছিলাম।” উনি বললেন, “তাই? বোরখা পরেছিলাম?” আমি তখন সেই পুরনো প্রসঙ্গ তুললাম। বললাম, “আপনি আমাকে সেট থেকে বার করে দিয়েছিলেন।” শুনে উনি খুব লজ্জা পেয়ে গেলেন। বললেন, “এ মা, ছি ছি। তাই হয়েছিল বুঝি?”
এটাই সুচিত্রা সেন। সব সময়েই ধরা দিলাম অথচ দিলাম নাএমন একটা ভাব। শত আড্ডার মধ্যেও আবছায়া রেখে দেওয়া।
মাসখানেকের মধ্যে ওঁর আমন্ত্রণেই আবার গেলাম। এ বার সপরিবারে। আমার কন্যা ক্যামেরা নিতে চাইলেও আমি বারণ করি। সে কথা শুনেই উনি বললেন, “সে কী! ক্যামেরা আনোনি কেন? এখনই নিয়ে এসো।” ছবি তোলার আগে বললেন, “দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি তো বেশ লম্বা। আমি হিল-টা পরি!”
এর কিছু দিন পরেই আমার স্ত্রী হেপাটাইটিস বি-তে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। উনি বললেন, দেখতে যাবেন। বললেন, “ঠিক ঘোমটা টেনে চলে যাব। গৃহদাহ করার সময়ে আমারও খুব খারাপ ধরনের জন্ডিস হয়েছিল।” মনে পড়ে গেল, ষাটের দশকের শেষে গুজব রটেছিল যে, সুচিত্রা সেনের নাকি ক্যানসার হয়েছে। আসলে হয়েছিল হেপাটাইটিস।
গত দশ-বারো বছর আর যোগাযোগ ছিল না। ওঁর প্রাইভেসিকে বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু যে ক’বার কথা হয়েছে, লক্ষ্য করেছি, ওঁর সম্পর্কে যা লেখা বা বলা হয়, তা নিয়ে উনি যথেষ্ট কৌতূহলী। ওঁকে বলেছিলাম, “এক বার মফস্সলে আমাদের মিটিং দু’ঘণ্টা পিছিয়ে দিতে হয়। টিভি-তে ‘উত্তরফাল্গুনী’ চলছিল।” সুচিত্রা বললেন, “ছবিগুলো লোকে দেখে কী করে? এত খারাপ প্রিন্ট হয়ে গেছে ওগুলোর।” তখনই বুঝলাম উনি খবর রাখেন। নইলে প্রিন্ট খারাপ, জানলেন কী করে? |