সুচিত্রা সেন ‘মহানায়িকা’। কেন মহানায়িকা, কাকে বলে মহানায়িকা সেই তর্ক বাঙালির কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ বাঙালি বিশেষণপ্রিয়। অভিনয় না গ্ল্যামার, তারকা হয়ে ওঠার পক্ষে অপরিহার্য কোনটা, নাকি দু’টোই? সেই চুলচেরা বিচারে আগ্রহ নেই বাঙালির। তার কাছে উত্তমকুমার ‘মহানায়ক’, সুচিত্রা সেন ‘মহানায়িকা’। সৌকর্য, সৌন্দর্য এবং সম্মোহের প্রতীক। প্রেমের প্রতীক।
বাঙালির কাছে আজও সুচিত্রা সেন মানেই রিভলভারের গুলিতে টেবিলল্যাম্প ভেঙে খানখান, আড়ালে উদ্ধত যৌবনের হাসি নিয়ে রিনা ব্রাউন! ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল রিনা। নিষ্পলক একটা জিজ্ঞাসাই ঠিকরে বেরোল তার মুখ থেকে, “তুমি আমাকে এখনও এত ভালবাসো, কৃষ্ণেন্দু?” |
সুচিত্রা বাঙালির মনে সেই উদ্ধতযৌবনা ছবি হয়েই থাকতে চেয়েছিলেন। যখন বয়সের কারণেই সেটা আর সম্ভব নয় বুঝলেন, সরে গেলেন অন্তরালে। ১৯৭৮-এ ‘প্রণয়পাশা’ ছবিতে শেষ কাজ। তারপর সহস্র অনুনয় সত্ত্বেও আর আসেননি ক্যামেরার সামনে। হয়তো তাঁর যে রোম্যান্টিক ইমেজটি একদা ছিল বাঙালির সকল পাওয়া, তাকে ভেঙে ফেলতে চাননি। সেই গোপনচারিণী রহস্যের কাছেই আজ হার মানল মৃত্যু। বাঙালি ফের উপলব্ধি করল, কিংবদন্তির মৃত্যু নেই। সুচিত্রা সেন যত না বড় অভিনয়শিল্পী, তার চেয়েও বড় কিংবদন্তি।
এই কিংবদন্তি ছুঁয়ে আছে দুই বাংলাকেই। আজকের বাংলাদেশের পাবনা শহরে জন্মেছিলেন করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের পঞ্চম সন্তান। তখন নাম রাখা হয় কৃষ্ণা। জন্মের তারিখটা ৬ এপ্রিল ১৯৩১। ছ’শো বছরেরও আগে এই তারিখেই ইতালির গির্জায় এক সুন্দরী রমণীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল প্রাক্তন এক যাজকের। যাজকের নাম পেত্রার্ক। পরবর্তী কালে নিজের সনেটে তিনি অনন্তযৌবনা করে রাখেন লরা নামে সেই নারীকে। লরা কোন কোন গুণে গুণান্বিত ছিলেন, পাঠক জানে না। শুধু জানে, লরার সম্মোহনী সৌন্দর্যের কথা।
সুচিত্রাও সেই নারী, যিনি সম্মোহনী সৌন্দর্যের আগল ভাঙলেন না। বয়সের সঙ্গে নিজেকে পাল্টে গড়ে নিলেন না নতুনতর চরিত্র, পা রাখলেন না নিরীক্ষার আঙিনায়। পর্দার অভিনয়জীবনে নিজের যে চূড়ান্ত রোম্যান্টিক প্রতিমাটি গড়ে তুলেছিলেন, স্বেচ্ছা-অন্তরালের জীবনে তাকেই পরিণত করলেন সসম্ভ্রম নস্টালজিয়ায়।
সেখানেই কি রয়ে গেল ব্যর্থতা? সেই অর্থে সুচিত্রা তাঁর সমসাময়িক সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল সেন বা তপন সিংহ, তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালকের কাছেও পরীক্ষিত নন। তিনি হয়ে ওঠেননি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র নীতা, ‘চারুলতা’ বা ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’-এর কুন্তী। এই না-চাওয়া, না-পাওয়া থেকেই কি ক্রমশ সরে গেলেন নিভৃত সঙ্গোপনে? গভীর রাতে বেলুড়ে যাওয়াই হয়ে দাঁড়াল বহিঃপৃথিবীর সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ!
সুচিত্রার শেষ চার দশকের এই নেপথ্যচারিণী অবগুণ্ঠনের সঙ্গে বাঙালি বরাবর গ্রেটা গার্বোর তুলনা করেছে। কিন্তু ‘কুইন ক্রিস্টিনা’ ছবির নায়িকা ফরাসি তাত্ত্বিক রোলা বার্তকেও উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ‘গার্বোর মুখ ছিল আইডিয়া, অড্রে হেপবার্নের মুখ ছিল ইভেন্ট’, লিখেছিলেন বার্ত। সুচিত্রার মুখে আইডিয়া একটিই...। কেরিয়ারের একেবারে গোড়াতেই তিনি দেবকীকুমার বসুর ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ ছবিতে। সেখানে দেবকীবাবু বেশির ভাগ সময় নায়িকাকে ধরেছিলেন ক্লোজ শটের সফ্ট ফোকাসে। ওই সফ্ট ফোকাসই হয়ে দাঁড়ায় সুচিত্রা-চিহ্ন।
অভিনয়ের উৎকর্ষের চেয়ে ওই সুচিত্রা-চিহ্নকেই বাঙালি ভালবেসেছে উদ্ভ্রান্তের মতো। দেশভাগ-পরবর্তী পঞ্চাশ-ষাটে জীবনযুদ্ধে জেরবার বাঙালির স্বপ্নপূরণের নায়িকা ছিলেন সুচিত্রা। উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর জুটি হয়ে উঠেছিল চিরন্তন প্রেমের প্রতীক। শেষ দৃশ্যে উত্তমকুমারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেন বলে? হয়তো তাই। অথবা হয়তো এই প্রেম বাঙালির গহন অবচেতনে লুকিয়ে থাকা বৈষ্ণব গীতিকবিতা। তাঁর রমা ডাকনামেও তো সেই বৈষ্ণব প্রেমেরই অনুষঙ্গ। রমা, রম্য, পরম রমণীয়।
সুচিত্রার তারকাদ্যুতির অন্যতম আর একটি কারণ: পঞ্চাশের দশকের স্বাধীনতা-উন্মুখ বাঙালি নারী। যিনি অভিভাবকের অমত সত্ত্বেও নিজের প্রেমিককে বেছে নেন। দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, স্লোগানমুখর টালমাটাল বাংলায় নারীর স্বেচ্ছা-নির্বাচনের অধিকার তুলে ধরেন। কিন্তু শেষ অবধি পিতৃতন্ত্রকেও মেনে নেন।
মাঝে মাঝে অসিত সেন বা অজয় করের পরিচালনায় অবশ্য আপাত ভাবে অন্য সুচিত্রাকেও পাওয়া যেত। ‘উত্তরফাল্গুনী’র অসহায় ‘পান্নাবাই’। কিংবা ‘সাত পাকে বাঁধা’র শেষ দৃশ্যে ক্রমশ ফেড-আউট হয়ে যাওয়া অভিমানিনী শিক্ষিকা! এই ছবির জন্যই মস্কোয় সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। কিন্তু এগুলিও রোমান্টিক নায়িকার রকমফের। ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে প্রেমের জন্যই পাগল হয়ে যান তিনি। ‘উত্তরফাল্গুনী’তে বিকাশ রায়ের সঙ্গে প্রেমই পূর্ণতা পেল মৃত্যুতে। ‘সাত পাকে বাঁধা’র শেষেও ডিভোর্স মেনে নিতে পারেন না তিনি, ছুটে গিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিত্যক্ত ঘরে।
সুচিত্রা কি নায়িকা এবং তারকাবৃত্তের বাইরে আদৌ পা রাখতে চেয়েছিলেন? উত্তমকুমার খ্যাতির মধ্যগগনে থেকেও ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ অভিনয় করেছেন। শেষ দিকে ‘অগ্নীশ্বর’, ‘বাঘবন্দি খেলা’, ‘যদুবংশে’ অন্য রকম অভিনয়ের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সুচিত্রা ‘আঁধি’তে বেশি বয়সের চরিত্র করলেও তা ছিল এক ব্যতিক্রমী দৃপ্ত মহিলার চরিত্র, অনেকে যাঁর মধ্যে ইন্দিরা গাঁধীকেই খুঁজে পান। চেনা গণ্ডির বাইরে বেরনোর চ্যালেঞ্জটাই যেন নিলেন না সুচিত্রা। গোপনচারিণী হওয়া ছাড়া তাঁর গত্যন্তর রইল না।
অবশ্য এটাই তাঁর স্বনির্বাচিত অবস্থান। ভাল-মন্দ, তর্ক-বিতর্ক অতিক্রম করে এই অবস্থানেই তিনি অনন্যা। এরই জন্য জনসমুদ্রের উন্মাদনা। সমকালে, উত্তরকালেও। |