সেলুলার জেলে ‘বন্দেমাতরম—দ্য নিউ লাইট’। গত প্রজন্ম থেকে আগামী প্রজন্মের কাছে গভীর অনুভূতির সুন্দর এক মেলবন্ধন। যেখানে রয়েছে দেশাত্মবোধ, সহমর্মিতা ও আত্মত্যাগের আরও এক প্রেরণা। এটি ফুটিয়ে তুলতে রাগ-অনুরাগ মিউজিক রিসার্চ অ্যাকাডেমি গত কয়েক বছর ধরেই গবেষণা চালিয়েছেন বিভিন্ন প্রজন্মের কাছে। আনা হয়েছে বেশ কিছু বৈচিত্র। কী ভাবে? বন্দেমাতরম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সৃষ্টি উপস্থাপিত হলেও এখানে বৈচিত্র আনতে দেশাত্মবোধকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে সেলুলার জেলকে প্রাধান্য দিয়ে। যাতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও সেই ঐতিহ্য অটুট থাকে। বৈচিত্র অন্য ভাবেও। একক গান নয়। সাতটি ভিন্ন সুরে বন্দেমাতরম-এর মূল নির্যাসকে তুলে আনা হয়েছে। যেমন ফিউশন, ফোক, পঞ্জাবি (ভাংরা), গীত, কীর্তন, দক্ষিণ ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য। মূল উদ্যোক্তা স্মৃতি লালার কথায়, “প্রত্যেক ভারতীয়ই যাতে বন্দেমাতরমের স্বাদ পেতে পারেন তাই এই প্রচেষ্টা। প্রাক্ স্বাধীনতার সময়ে এই বন্দেমাতরমের কী গুরুত্ব ছিল তার স্বাদ নতুন প্রজন্ম কেন পাবে না?” আসলে কোনও কিছুই জোর করে মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া যায় না। উগ্র জাতীয়তাবাদ বা কোনও চরমপন্থা দেশকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিতে পারে। তেমনই জাতীয়তাবাদ পারে মানুষকে সচেতন করতে। উদ্যোক্তাদের দাবি, “এর আরও একটি কারণ আছে। এখন আমরা কেবলই অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের কথাতেই মশগুল হয়ে আছি। মনে রাখতে হবে, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে তারাই সবচেয়ে সফল, যাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে বেশি।”
সপ্তসুরের প্রয়োগ কি সেই কারণেই? |
এই সপ্তসুর এখানে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষকে একত্র করার সূক্ষ্ম অনুভব। এমনকী সপ্তসুর এখানে শুধু মাত্র শ্রবণে থাকছে না। সুরে-তালে-ছন্দে সেই সুর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেই সব মানুষকে তুলে আনা হয়েছে ভিডিও রেকর্ডিংয়েও। তবে প্রাধান্য পেয়েছে সবচেয়ে আগে সেলুলার জেল। কারারুদ্ধ সেই সব বিপ্লবীর কথা এখন ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু প্রতিটি ইটের খাঁজে লুকিয়ে আছে কত দীর্ঘশ্বাস ও যন্ত্রণার অলিখিত বাণী। শিহরিত হতে হয়, সপ্তসুরের প্রতিটি ছত্রে যখন ক্যামেরার লেন্সে উঠে আসে সেই আলো-আঁধারির প্রতিচ্ছবি। এত ত্যাগ! নতুন প্রজন্ম সবটা জানে তো?
এই ইতিহাস তো জানতেই হবে। আশাবাদী স্মৃতি লালা—“যে দিন সেলুলার জেলের ভেতরে শ্যুটিং করছি সেই সময় ওখানকার মানুষের কী আগ্রহ। তখনকার বন্দি এক তরুণ বিপ্লবী এখন ওখানকারই বাসিন্দা। বয়সের ভারে ন্যূব্জ। চোখে ভাল দেখতে পান না। লাঠিতে ভর করে এসে দেখছেন, খুঁজে পেতে চাইছেন সেই ইতিহাসের দিনগুলি। ব্যাকগ্রাউন্ডে তখন চলছে সপ্তসুরের ধ্বনি। আচমকা তিনি নাতি-নাতনির হাত ছাড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠলেন, বন্দেমাতরম! দাদুর সঙ্গে কাঁদছে ওঁর নাতি-নাতনিও।” এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম।
এমনই শিহরন ওয়ান্ডুরের সমুদ্র সৈকতে। রাগ-অনুরাগের কুশীলবরা যখন জাতীয় পতাকা হাতে দৌড়ালেন, তখন পিছনে সেই দৌড়ে শামিল হয়েছেন মাছ ধরা পরিবারের অনেকেই। ওই দৃশ্যই বদলে যায় যখন পঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরের পাশে জাতীয় পতাকা নিয়ে নৃত্যের তালে তালে কণ্ঠ মিলিয়েছেন শিল্পীরা। বা বোলপুরের সেই অখ্যাত গ্রাম। মেঠো রাঙামাটির আল বেয়ে জোড়া তালগাছের নীচে খালিগায়ে গ্রামের শিশুদের উচ্ছ্বাস জাতীয় পতাকা হাতে। সবাই যে নিজের ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন বন্দেমাতরমের সুরও। কারণ সপ্তসুরে শুধু তো বাংলা নয়, হিন্দি-উর্দু, মৈথিলি সহ অনেকগুলি আঞ্চলিক ভাষাও সংযোজিত হয়েছে। সঙ্গে কবিতাও। রয়েছে ইতিহাসের পাতা খুঁজে তুলে আনা বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ অনেকেরই সেই সময়কার জোরালো বক্তব্য।
এর আগে বন্দেমাতরম নিয়ে অনেক গীতি-আলেখ্য হয়েছে। কিন্তু তা একক সুরে। স্মৃতি লালার দাবি, “বিভিন্ন সুরের প্রয়োগে বন্দেমাতরম নিয়ে এমন কথার মালা সম্ভবত আমরাই প্রথম করলাম।” বুধবার এরই শুভ সূচনায় থাকছেন কিংবদন্তি দৌড়বিদ মিলখা সিংহ। এই সংকলনের চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন বিচারপতি অমিতাভ লালা। |
সম্প্রতি অপ্রচলিত রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কয়েকটি অনুষ্ঠান হলেও তার সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। সেই কারণেই হয়তো ত্রিগুণা সেন মঞ্চে অপালা বসু (সেন)-এর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় নিবেদন হল ‘স্বরবিতানের পাতা খুঁজে’। অপালা তাঁর ‘ব্রতী’র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে কঠিন তাল ও সুরের গানগুলিকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াস নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। এ দিন তিনি নিজে গান করেননি। ভবিষ্যতের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে যাদের সম্ভাবনা আছে তাদেরকে নিয়েই সমবেত ও একক গানের উদ্যোগ নিয়েছেন। পরিষ্কার কণ্ঠ অভিরূপ দত্তের। ‘তরুণ প্রাতের অরুণ আকাশ’ গানটি যেমন ভাবে গাওয়া দরকার সেই ভাবেই শুনিয়েছেন। কৌস্তভ ঘোষের ‘তুমি জাগিছ’ও বেশ ভাল তবে মন্দ্রসপ্তকে তাঁর কণ্ঠ আরও পরিষ্কার হওয়া উচিত। |