|
|
|
|
মহিষাদলে আজও অমলিন দত্তার দু’দিন
অমিত কর মহাপাত্র • মহিষাদল |
পুব দিকের গোল বারান্দার রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, “পরেশ পরেশ, মা ঠাকুরন ডাকছেন?”
মহিষাদল রাজবাড়িতে বিমল দে পরিচালিত ‘দত্তা’ সিনেমার শ্যুটিংয়ে এটিই ছিল সুচিত্রা সেনের প্রথম সংলাপ। সেই সংলাপ আজ সেলুলয়েডে বন্দি। তবে মহানায়িকার প্রয়াণে বিজয়ার সেই সংলাপ, সেই উচ্ছ্বলতাই যেন আজ আরও একবার রাজবাড়ির অন্দরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সেই স্মৃতিচারণে বসে আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না রাজ পরিবারের সদস্য থেকে রাজবাড়ির কর্মী, কেউই।
সেটা ১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মকাল। মহিষাদল রাজবাড়িতে দু’দিন ধরে দত্তার শ্যুটিং হয়েছিল। এসেছিলেন সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায় (নরেন), উৎপল দত্ত (রাসবিহারী), শমিত ভঞ্জ (বিলাসবিহারী) এবং অবশ্যই মহানায়িকা। শ্যুটিংয়ের সময় রাজবাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকের যে ঘরে সুচিত্রা ছিলেন, সেখানে তাঁর ছবিতে শুক্রবার সকালে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাজবাড়ির সদস্য ও কর্মীরা। শুক্রবার মহানায়িকার মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্রই শ্যুটিংয়ের সময় ‘বিজয়া’র স্মৃতি বিজড়িত থাকার ঘর, শ্যুটিং স্পট দেখতে ভিড় জমান গ্রামবাসীরা।
শ্যুটিংয়ের সময় সকালবেলা রাজবাড়ির গোলবারান্দার সেন্টার টেবিলে চা খেতেন তিনি। রাজবাড়ির প্রবীণ সদস্য পচাঁত্তর বছরের চন্দনপ্রসাদ গর্গ তখন যুবক। তাঁর স্মৃতিতে এখনও ঝকঝকে সেই দিনগুলি। তাঁর কথায়, “সুচিত্রাদেবীর আচরণে কোনও কৃত্রিমতা ছিল না। সকলের সঙ্গেই কথা বলতেন।” |
মহিষাদল রাজবাড়ির এই ঘরেই ছিলেন মহানায়িকা। ব্যবহার করেছিলেন আসবাবও।
শুক্রবার তাঁর প্রয়াণের পর মাল্যদান করলেন রাজ পরিবারের সদস্য চন্দনপ্রসাদ গর্গ। —নিজস্ব চিত্র। |
সেই সময় বেঁচে ছিলেন রাজবাহাদুর দেবপ্রসাদ গর্গ ও রানি কল্যাণী গর্গ। ৭৮ বছরের রানিমার সঙ্গে নিজে থেকেই আলাপ করেছিলেন সুচিত্রা। শ্যুটিংয়ের সময় সুচিত্রার সঙ্গে থাকতেন দেবপ্রসাদবাবুর ভাগ্নি মীরাদেবীর মেয়ে চোদ্দো বছরের দেবযানী। দেবযানী ও চন্দনপ্রসাদবাবু মিলে সুচিত্রাকে দোতলার বৈঠকখানার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে রানিমার সঙ্গে গল্পও জমেছিল ভালই। রাজবাহাদুর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তি ফৈয়াজ খাঁর শিষ্য। তা জানার পরই তাঁর কাছ থেকে ‘প্রেম প্রিয়া’ ঘরানার গানও শোনেন তিনি। সুচিত্রা সে দিন নিজে গান করেননি তবে জানিয়েছিলেন, তাঁরও দু’টি গানের রেকর্ড রয়েছে। শ্যুটিং করতে এসে তিনি কখনও নিজেকে আভিজাত্যের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখেননি। উৎসাহী মন নিয়ে তিনি ঘুরে দেখেন রাজবাড়ির নাচমহল, অস্ত্রখানা, সঙ্গীতশালা। চন্দনপ্রসাদবাবু বলেন, “শ্যুটিংয়ের ফাঁকে সময় পেলেই তিনি সকলের সঙ্গে গল্প করতেন। তিনি যে এতবড় নায়িকা তা কখনও বুঝতেই দিতেন না। আজও যেন রাজবাড়ির আনাচে-কানাচে তাঁর উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছি। তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই মনটা ভাল নেই।”
সিনেমার কয়েকটি দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের ছবি এখনও যেন রাজবাড়ির সদস্যদের মনে অমলিন। তাঁর মধ্যে একটি দৃশ্যে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলেন সুচিত্রা। রাজবাড়ির সিঁড়ি দিয়ে তিনি উঠছেন। সেই সময় উৎপল দত্ত বললেন, “শরবত কর, শরবত কর, এসে গেছেন।” ‘দত্তা’ সিনেমার অন্য আর একটি দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের কথা এখনও সুন্দরা গ্রামের সুব্রত চক্রবর্তীর মনে গেঁথে রয়েছে। তখন তিনি পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তিনি বলেন, “সিনেমার একটি দৃশ্যে রাজবাড়ির সামনে হিজলি টাইডাল ক্যানালের পাড় ধরে গিয়েছে ইটের টুকরো ফেলা রাস্তা। শ্যুটিংয়ের জন্য খালের উপর তৈরি করা হয়েছিল একটি বড় বাঁশের সাঁকো। সেই সাঁকোয় বসে খালের জলে ছিপ ফেলছিলেন সৌমিত্র। সুচিত্রা খাল পাড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে ওই সাঁকো পার হয়ে গেলেন।” আবেগাপ্লুত হয়ে সুব্রতবাবু বলেন, “আমি ভাগ্যবান, যে মহানায়িকাকে নিজের চোখে দেখেছি।” রাজবাড়ির কর্মী তখনকার কলেজ ছাত্র গড়কমলপুর গ্রামের বাসিন্দা স্বপন চক্রবর্তীর কথায়, “আমার বাবা রাজ এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। ওই এলাকায় ভাল শাঁখালু হয় বলে শুনে তিনি শাঁখালু খেতে চান। এই খবর শুনে স্থানীয় চাষিরা সুচিত্রাদেবীকে শাঁখালু এনে দিয়েছিলেন। তা তৃপ্তি করে খেয়েছিলেন সুচিত্রা, সৌমিত্র-সহ অন্যরা। এই স্মৃতিটাই আমার জীবনে অমূল্য হয়ে থাকবে।”
মহানায়িকা আর নেই, সেই দুঃখের মাঝেও কোথাও যেন তাঁর সেই হাসির শব্দকে মনে রেখেই খুশি থাকতে চায় মহিষাদল রাজবাড়ির সদস্যরা। |
|
|
|
|
|