নিঃসঙ্গ নায়ক লইয়া বহু ছবি হইয়াছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’-এ উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রটির কালো চশমা যেন জীবনকে দুই ভাগ করিয়া দেয়, এক দিকে সমগ্র পৃথিবী, অন্য দিকে নিঃসঙ্গ নায়ক। ওই চশমার অন্ধকার অন্তরালে নায়কটির স্বরূপ সকলের অগোচরেই রহিয়া যায়। ফরাসি পরিচালক লুই মাল-এর ‘আ ভেরি প্রাইভেট অ্যাফেয়ার’ ছবিতে ব্রিজিত বার্দো অভিনয় করেন এক মহাতারকার ভূমিকায়, অতি দ্রুত প্রাপ্ত প্রবল খ্যাতির চাপেই যিনি চূর্ণ হইয়া যান, প্রণয়সম্পর্ক আঁকড়াইয়া আলোকবৃত্ত হইতে পলাইতেও চাহেন, কিন্তু সেই দৌড় শেষ হয় মৃত্যুতে। কেবল চলচ্ছবি-তারকা নহেন, যে কোনও কৃতী ব্যক্তি, যাঁহাকে সর্ব ক্ষণ পরিবৃত করিয়া আছে বহু মানুষ, স্তাবক-অনুরাগী-ভক্ত-বিশ্লেষক, তাঁহারই অন্দরে এই সমষ্টি-সান্নিধ্যই এক প্রবল নিঃসঙ্গতার জন্ম দেয়। হয়তো কীর্তিমান মানুষটিকে প্রতিনিয়ত বহিয়া চলিতে হয় এক বৃহৎ-আমি’র ভার, যাহা তাঁহাকে ক্ষুদ্র, সাধারণ আনন্দগুলি হইতে দূরে সরাইয়া দেয়। হয়তো এত জন মানুষের দৃষ্টি ও মনোযোগ তাঁহাকে আত্মসচেতন করিয়া রাখে, জীবনে নানাবিধ খেলাচ্ছল ভোগ করিবার অনুমতি দেয় না। মানুষ প্রতি মুহূর্তে নিজেকে দেখিয়াও বিস্মিত হয়। কিন্তু নিজের মহামূর্তি অনুযায়ী প্রতি মুহূর্ত কাজ করিয়া যাইতে হইলে, মহত্ত্বের নিকট সেই আত্মবিলাস বলিপ্রদত্ত হয়।
নায়িকা সুচিত্রা সেন তাঁহার অভিনয়কালে সহস্র মানুষ পরিবৃত হইয়া থাকিতেন। সেই সমষ্টি-আরোপিত নিঃসঙ্গতার সময় অতিক্রান্ত হইবার পর, তিনি আক্ষরিক নিঃসঙ্গতার আবরণ স্বেচ্ছায় টানিয়া লইয়া এক এমন রূপকথা সৃষ্টি করিলেন, যাহা ইতিহাসের সহিত ওতপ্রোত হইয়া গেল। তাঁহাকে কখনওই গতরূপ ও বীতরহস্য অবস্থায় দর্শক দেখিতে পাইল না, তাহাদের নিকট দীপ্তিময়ী সম্রাজ্ঞী হিসাবেই তিনি চিরবিরাজ করিলেন, রূপালি পরদায় রশ্মি-নিক্ষিপ্ত ছবিগুলিই তাঁহার প্রতিনিধিত্ব করিল: এই আদর্শ-নাট্যটি সুচিত্রা নিজ জীবন দিয়া লিখিলেন। এই নিশ্ছিদ্র অন্তরাল রচনা করিতে গিয়া তাঁহাকে হয়তো সর্বোচ্চ খাজনা দিতে হইল। এই প্রতিজ্ঞার ফলে তাঁহাকে ত্যাগ করিতে হইল উদার আলোক অগাধ বাতাসের আমন্ত্রণ, অসংখ্য বন্ধুতা, গণমাধ্যমের সহস্র তাৎক্ষণিক করতালি। তিনি এমনকী এই সংকল্প-পথে, বিস্মরণকেও বাজি রাখিলেন। দীর্ঘ দিন-মাস-বৎসর জনজীবন হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ সরাইয়া লইলে জনতা নায়িকাকে ভুলিয়া যাইতে পারে, সেই ঝুঁকিও তিনি লইয়াছিলেন। কিন্তু একটি অতিকথা রচনার আকর্ষণে একটি আত্মনিগ্রহী যাপনকে যে তিনি শ্রেয় ভাবিলেন, কারণ তিনি তাঁহার জীবন অপেক্ষা রূপালি পরদায় প্রতিফলিত নিজ ছবিটিকে অধিক ভালবাসিয়াছিলেন। যেন তেন প্রকারেণ সেইটিকেই একমাত্র পরিচয় হিসাবে প্রতিভাত করিবার জন্য, তিনি বিশাল পৃথিবীর পসরা প্রত্যাখ্যান করিলেন, কারণ সমাজের সহিত মিলিয়ামিশিয়া রূপ-রস-ঘ্রাণ ভাগ করিয়া বাঁচিবার তুলনায় খ্যাতি ও লাবণ্য-গরিমার জ্যোতিপরিধি তাঁহার নিকট অধিক বরণীয় মনে হইয়াছিল। তাই স্বেচ্ছাবৃত একাকিত্বের সকল দণ্ড ভোগ করিতে হইবে জানিয়াও, আত্মমুগ্ধতার নিকট পরাজয় বরণ করিলেন। এই দিক হইতে, তিনি বঙ্গজীবনের শ্রেষ্ঠ নার্সিসাস। সুচিত্রা সেনের সর্বাধিক উন্মাদ অনুরাগী সুচিত্রা সেন। তবে একটি প্রশ্নও থাকিয়া যায়। এই যে গণবিমুখ নিঃসঙ্গতা সুচিত্রা নিজের উপর এমন সাড়ম্বরে আরোপ করিলেন, তাহার নেপথ্যে কি তিনি সত্যই নিঃসঙ্গ ছিলেন? |