খুচরা ব্যবসায়ে কেন বৃহৎ বিনিয়োগ প্রয়োজন, এই ২০১৪ সালেও তাহার ফিরিস্তি দেওয়াকে যে কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ বাহুল্য বোধ করিবেন। কিন্তু, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ন্যায় রাজনীতিকরা দৃশ্যতই এখনও সেই প্রয়োজন বুঝিতে পারেন নাই। বৃহৎ বিনিয়োগের অভাবে ভারতে খুচরা ব্যবসায়ের পরিকাঠামো এখনও অতি দুর্বল। সেই দুর্বলতাকে ব্যবহার করে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি। বৃহৎ বিনিয়োগ আসিলে ফসল মজুত রাখিবার হিমঘর তৈরি হইবে, বহু ক্ষেত্রে রাস্তারও উন্নতি হইবে। এবং, বৃহৎ সংগঠিত খুচরা ব্যবসায়ী সংস্থার সরাসরি কৃষকের নিকট হইতে ফসল কিনিবার মতো পরিকাঠামো থাকে। ফলে, মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির মুনাফা মারা যাইবে ঠিকই, কিন্তু কৃষক ও ক্রেতা, উভয় পক্ষেরই লাভ। কেজরিওয়াল আদি নেতাদের তাহাতে আপত্তি কেন? কেজরিওয়াল জানাইয়াছেন, বিদেশি বিনিয়োগমাত্রেই যে তাঁহার আপত্তি, তেমনটি নহে। আবার, দেশি বৃহৎ খুচরা ব্যবসায়ীদের প্রতিও দৃশ্যত তিনি বিরূপ নহেন। তাহা হইলে খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগে তিনি সম্মত নহেন কেন? বিদেশি-ভীতির সস্তা রাজনীতি ভিন্ন আর কোনও কারণ নজরে পড়িতেছে না।
কেজরিওয়াল অবশ্য বলিয়াছেন, খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ আসিলে পাড়ার মুদিখানাগুলি মার খাইবে, ফলে কর্মসংস্থান কমিবে অতএব তিনি এই বিনিয়োগের বিরোধী। তাঁহার যুক্তিটি শুনিলে প্রমোদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুরা প্রীত হইতেন। তিন দশক পূর্বে তাঁহারা ব্যাঙ্কে কম্পিউটার আনিবার বিরোধিতায় এই ধরনের যুক্তিই ব্যবহার করিয়াছিলেন। কিন্তু হায়! কালের স্রোতকে প্রতিহত করিবার শক্তি এমনকী আশির দশকের বামপন্থীদেরও ছিল না। শেষ পর্যন্ত কম্পিউটার স্বমহিমায় আসিয়াছে। তাহাতে কর্মসংস্থানের ক্ষতি হইয়াছে, লজ্জার মাথা খাইয়া এই কথাটি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটেও কেহ বলিবেন না। বামপন্থীরা যে ভুলটি করিয়াছিলেন, কেজরিওয়াল তিন দশক পরে তাহার পুনরাবৃত্তি করিতেছেন। যুগের ধর্ম এবং কাণ্ডজ্ঞানের বিপ্রতীপ অবস্থানে জয়ী হইবার মতো জোর তাঁহারও নাই। তিনি খানিক জল ঘোলা করিতে পারিবেন মাত্র। রাজনীতি অবশ্য সেই ঘোলা জলেরই খেলা। খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ আসিলে কর্মসংস্থানের ক্ষতি হইবে না, বড় জোর তাহার চরিত্র বদলাইবে। কিন্তু সেই চরিত্রবদলের ভয়ে বিদেশি পুঁজি ও তাহার সুফলগুলির পথ রোধ করিতে চাহিলে তো পালকিবাহকদের কর্মসংস্থানের কথা ভাবিয়া মোটরগাড়ির বিরোধিতা করা উচিত ছিল। তবে, এই যুক্তি এক পক্ষের। কেজরিওয়াল বলিতেই পারেন, তিনি সর্বদলের প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন না। তিনি তাঁহার দলের যুক্তির কথাই বলিবেন। সেই কথা বলিবার অধিকার তাঁহার বিলক্ষণ আছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করিয়া তিনি যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইয়াছেন, তখন নিজের কথা বলিবার অধিকারের পাশাপাশি তাঁহার একটি অনস্বীকার্য দায়িত্বও আছে বিভিন্ন মতের মধ্যে বিতর্কের পরিসরটি খোলা রাখা। আইনসভাই সেই বিতর্কের প্রকৃষ্ট পরিসর। দিল্লি বিধানসভায় খুচরা ব্যবসায় বিদেশি পুঁজি লইয়া বিতর্কের আয়োজন করা তাঁহার কর্তব্য ছিল। সেখানে তিনি ও তাঁহার সহকর্মীরা নিজেদের বিরোধিতার কথা বলিতেন, এবং বিদেশি বিনিয়োগের সমর্থকরা নিজেদের যুক্তি পেশ করিতেন। এই বিতর্কের মধ্য দিয়াই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাইত। ইহাই গণতন্ত্রের পথ। কেজরিওয়াল যে ভঙ্গিতে পূর্বতন সরকারের সিদ্ধান্ত নাকচ করিয়া নিজের মত চাপাইয়া দিয়াছেন, তাহা অগণতান্ত্রিক। দল এবং সরকারের মধ্যে ফারাকটি ভুলিবার নহে। এখন তিনি সরকার চালাইতে পারেন, কিন্তু তাহাতে অতীত মুছিয়া দেওয়া যায় না। সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতা বজায় রাখিতেই হইবে। কেজরিওয়াল এখনও নবীন। এই কথাগুলি তিনি যত দ্রুত সম্ভব, শিখিয়া লউন। |