কোথাও মারামারি-বোমাবাজি, কোথাও বা বাঁশ নিয়ে তাড়া করে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দিতে না-দেওয়া। বৃহস্পতিবারও জেলায় জেলায় ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অশান্তি চলেছে। তার পরে এ দিন ফের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির সংস্রব থেকে দূরে রাখার সওয়াল করেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন।
জেলার কলেজগুলির গোলমাল তো বটেই, কলকাতার ছ’টি কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিপুল পুলিশি ব্যবস্থাও প্রমাণ করেছে, রাজ্যপালের বক্তব্য যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। পুলিশের নজরদারি, ব্যারিকেড, পুলিশ কর্তাদের টহলদারি সব মিলিয়ে এ দিন ওই ছ’টি কলেজে নির্বাচন মোটের উপরে শান্তিপূর্ণ ভাবে মিটেছে। কিন্তু সেই আয়োজনই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, ছাত্রভোট থেকে দলীয় রাজনীতিকে দূরে রাখা হবে না কেন? লিংডো কমিশনের এই সুপারিশ মানলে তো এত পাহারা, ঘেরাটোপের প্রয়োজন পড়ত না। তবে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, দলীয় রাজনীতি বাদ দেওয়াই হিংসা বন্ধের উপায় নয়। সর্ম্পূণ অরাজনৈতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা এখনই ভাবছে না সরকার। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত লিংডো কমিশন নির্বিঘ্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে কয়েকটি সুপারিশ করেছিল। এর অন্যতম হল, ছাত্রভোটে রাজনৈতিক দলের সংস্রব ত্যাগ। এ ছাড়া, নির্বাচনের সময় বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, প্রার্থী হওয়ার জন্য অন্তত ৭৫ শতাংশ হাজিরা ও পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া বাধ্যতামূলক, ইত্যাদি সুপারিশও করেছিল ওই কমিশন। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে লিংডো কমিশন মেনেই নির্বাচন হয়।
পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য সুপারিশগুলি কার্যকর করেনি। বামফ্রন্টই হোক বা তৃণমূল ছাত্র সংসদ থেকে দলীয় রাজনীতি বাদ দিতে আগ্রহী নয় কেউই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে দখলে রাখতে পরিচালন সমিতি, ছাত্র সংসদ দখল করতে চায় তারা। বিরোধীদের মনোনয়ন পত্র তোলা ও জমা দেওয়ায় বাধা দিয়ে যে কোনও মূল্যে সংসদ দখলই লক্ষ্য হয় দলগুলির।
বৃহস্পতিবার নদিয়ার হরিণঘাটা কলেজে নির্বাচনের মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদেরই (টিএমসিপি) দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ বাধে। বোমাবাজিরও অভিযোগ উঠেছে। এই তাণ্ডবে মনোনয়ন পত্র জমা না দিতে পারার অভিযোগ তুলেছে এসএফআই।
এ দিনই মনোনয়ন পত্র জমা
দিতে মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ি কলেজে ঢোকার সময় এসএফআই সমর্থকদের মেরে বার করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে। মনোনয়ন জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে টিএমসিপি এবং ছাত্র পরিষদ কর্মীদের মারামারি বাধে হুগলির রিষড়া বিধানচন্দ্র রায় কলেজেও। কলেজ সূত্রের খবর, পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে ফর্ম জমা নেওয়া বন্ধ করে দেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। পুলিশ ছাত্রদের সরিয়ে দেয়। |
খড়্গপুর কলেজে এ দিন দুপুরে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গোলমালের জেরে লাঠি চালায় পুলিশ। অভিযোগ, এ দিন মনোনয়ন জমার সময় এসএফআই, ছাত্র পরিষদ ও এবিভিপি-র পড়ুয়াদের ওপরে হামলা চালায় টিএমসিপি। যদিও টিএমসিপি অভিযোগ উড়িয়ে এবিভিপিকেই এ ঘটনায় দায়ী করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
উত্তরবঙ্গেও এ দিন বেশ কয়েকটি কলেজে মনোনয়ন জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে গোলমাল হয়। শিলিগুড়ি মহিলা কলেজে এসএফআই সমর্থকদের মনোনয়ন পত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার জন্য টিএমসিপি বাঁশ হাতে তাড়া করে বলে অভিযোগ। টিএমসিপি অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছয় যে পুলিশ গিয়ে ব্যারিকেড করে এসএফআই-এর প্রতিনিধিদের কলেজে নিয়ে যায়। মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার পরে ছাত্রীদের পুলিশি পাহারায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনার জগমোহন বলেন, “ছাত্রীদের পুরো নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। গোলমালের কোনও খবর নেই।”
শিলিগুড়ি কমার্স কলেজে আবার ছাত্র পরিষদ ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ লাঠি চালিয়ে সংঘর্ষ ছাড়ায়। পুলিশি ঘেরাটোপে ছাত্র পরিষদ মনোনয়ন জমা দেয়। মালদহ কলেজে প্রায় দিনভর টিএমসিপি-র কর্মী-সমর্থকেরা গেট আটকে রাখায় এসআফআই-ছাত্র পরিষদের কেউ মনোনয়ন পত্র নিতে ঢুকতে পারেননি বলে অভিযোগ।
দক্ষিণ দিনাজপুরে হরিরামপুর কলেজেও এসএফআই মনোনয়ন পত্র তুলতে পারেনি। বুধবার ওই কলেজে সংঘর্ষের ঘটনার পরে টিএমসিপি-র অভিযোগে এসএফআইয়ের জেলা সভাপতি-সহ ৮ জন ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার মামলা শুরু হয়েছে। উত্তর দিনাজপুরের ডালখোলা কলেজেও মনোনয়ন পত্র তোলা নিয়ে টিএমসিপি ও ছাত্র পরিষদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এসএফআইয়ের। পুলিশের একটি জিপ ভাঙচুর হয়।
টিএমসিপি অভিযোগ করেছে, শ্রীরামপুর গার্লস কলেজে ডিএসও-র কর্মীরা মনোনয়ন পত্র ছিঁড়ে দেওয়ায় তারা তা জমা দিতে পারেনি। নতুন করে মনোনয়ন পত্র দেওয়ার দাবি জানায় তারা। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন নিয়ম নেই, এই দাবি মানা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন টিএমসিপি নেতৃত্ব। বুধবার শ্রীরামপুর আদালত ওই কলেজের ভোট স্থগিত করে দিয়েছে। জেলা টিএমসিপি সভাপতি শুভজিৎ সাউ বলেন, “আদালত ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ওখানে ভোট স্থগিত করেছে। সবাইকে নতুন করে মনোনয়ন পত্র দেওয়ার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলেছেন বিচারক।” |
অন্য দিকে, পুলিশ কম থাকার কারণে তারকেশ্বরের চাঁপাডাঙা কলেজে ভোট প্রক্রিয়া অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত হয়ে গেল। আজ, শুক্রবার থেকে সেখানে মনোনয়ন পত্র দেওয়ার কথা ছিল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ সমূহের পরিদর্শক দেবকুমার পাঁজা বলেন, “ওই কলেজে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পর্যাপ্ত পুলিশ দেওয়া যাবে না বলে হুগলির জেলাশাসক আমাদের জানিয়েছেন। আপাতত ওই কলেজে ভোট স্থগিত রাখা হচ্ছে।”
কলকাতায় এ দিন চারুচন্দ্র, শ্যামাপ্রসাদ, খিদিরপুর, রানি বিড়লা, আনন্দমোহন ও জয়পুরিয়া কলেজে নির্বাচন ছিল। কলেজ প্রাঙ্গনগুলি ছাত্র সংগঠনের পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে র্যাফ, পুলিশ, বাদ পড়েননি কেউই। এ ভাবে ছাত্রভোটকে প্রায় সাধারণ নির্বাচনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যুক্তি কী, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
রাজ্যপাল কিন্তু বরাবরই রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত ছাত্র সংসদের পক্ষে। এ দিন তিনি দশগ্রাম সতীশচন্দ্র সর্বার্থসাধক শিক্ষাসদনের ৭৫ বর্ষ পূর্তি উৎসবের সূচনা করতে যান পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ে। সেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এলেই সমস্যা হচ্ছে। আমার মতে কলেজে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। ছাত্র রাজনীতি এক জিনিস, দলীয় রাজনীতি সম্পূর্ণ আলাদা।” বক্তৃতার সময় রাজ্যপালের পাশেই ছিলেন সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। রাজ্যপাল তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, “মানসবাবুরা সহমত না-ও হতে পারেন। আমার কিন্তু এটাই অভিমত।”
|