বঞ্চনার অভিযোগ তুলে ফের কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। এ বারের বিষয় ১০০ দিনের কাজ, গ্রামীণ রাস্তা এবং কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের ভাগ না দেওয়া। পাল্টা হিসেবে কেন্দ্র বলল, দিল্লিকে খলনায়ক প্রতিপন্ন করে আসলে নিজেদের ব্যর্থতাই ঢাকতে চাইছেন রাজ্যের মন্ত্রীরা।
বৃহস্পতিবার নবান্নে রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, ১০০ দিনের কাজে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত রাজ্যকে ২৬০০ কোটি টাকা দিয়েছিল কেন্দ্র। নিয়ম অনুযায়ী, ওই টাকায় ৮০% কাজ শেষ করার পরে পরবর্তী ধাপের অর্থের জন্য আবেদন জানানো যায়। সেই মতো কাজ শেষ করে বাকি ২০% অর্থাৎ ১২০০ কোটি টাকা কেন্দ্রের কাছে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দিল্লি এ পর্যন্ত মাত্র ১০০ কোটি টাকা পাঠিয়েছে। এর ফলে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পগুলি শেষ করা যাচ্ছে না। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। সুব্রতবাবুর দাবি, “রাজ্য যে ভাবে কাজ শুরু করেছে, তাতে প্রচুর শ্রমদিবস তৈরির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণে সে সুযোগ নষ্ট হচ্ছে।”
সুব্রতবাবুর দ্বিতীয় অভিযোগ ‘প্রধানমন্ত্রী গ্রামসড়ক যোজনা’ নিয়ে। তাঁর কথায়, “এ রাজ্যে ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট অনুমোদন করেছে কেন্দ্র। তার ভিত্তিতে আমরা ৪৫০০ কোটি টাকার কাজ শুরু করেছি। কিন্তু কেন্দ্র এখনও পর্যন্ত একটি টাকাও দেয়নি! কেন দেয়নি, তার কোনও কারণও ব্যাখ্যা করেনি। অথচ অবিলম্বে ১৫০০ কোটি টাকা না দিলে রাস্তা তৈরির কাজই বন্ধ হয়ে যাবে।” সুব্রতবাবু জানান, গত বার এই প্রকল্পে ৪৫০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছিল এবং সেই টাকা দিয়েছিল দিল্লি। টাকার দাবি জানাতে চলতি মাসের ২২ তারিখে দিল্লি যাবেন সুব্রতবাবু। |
রাজ্যের অভিযোগ শুনে অবশ্য ভয়ানক ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। তাঁর দাবি, “কেন্দ্রকে খলনায়ক সাজিয়ে আসলে নিজেদের ব্যর্থতাই ঢাকতে চাইছে রাজ্য সরকার। বাস্তব হল, গত তিন বছরে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক থেকে পশ্চিমবঙ্গ যে পরিমাণ অর্থ পেয়েছে, তা নজিরবিহীন।” তাঁর কথায়, “সুব্রতবাবু এবং অমিত মিত্র আমার ভাল বন্ধু। তাঁরাও এই রাজনীতি করবেন, আমি কখনওই প্রত্যাশা করিনি।” রমেশের পাল্টা দাবি, ১০০ দিনের কাজ নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে, ওই প্রকল্পের ৫৮৪ কোটি টাকা রাজ্যের হাতে পড়ে রয়েছে। তার পরেও আরও ১০০ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয়েছে। আজ, শুক্রবার তথ্য দিয়ে রাজ্যের অভিযোগের জবাব দেবেন বলে জানিয়েছেন জয়রাম।
কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও। তাঁর দাবি, কেন্দ্র যে কর আদায় করে তার থেকে রাজ্যের প্রাপ্য দেওয়া হচ্ছে না। অমিতবাবুর বক্তব্য, রাজ্য থেকে যে রাজস্ব আয় হয়, তার ৩২.৫% রাজ্যগুলির মধ্যেই ভাগ করে দেওয়ার কথা বলেছে অর্থ কমিশন। ওই ৩২.৫%-র মধ্যে ৭.৩% অর্থ প্রাপ্য পশ্চিমবঙ্গের। এই হিসেব অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে পাওনা হয়েছে ১৮০৪ কোটি টাকা। মাসের প্রথমেই সেই টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কথা কিন্তু কেন্দ্র ৪২৫ কোটি টাকা কম দিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর দাবি, “রাজ্যের প্রাপ্য দিতে কেন্দ্র এমন আচরণ করলেও রাজ্যের থেকে নিজেদের পাওনা বুঝে নিতে কিন্তু দেরি করছে না। নভেম্বরেই রাজ্যকে দেয় অর্থ থেকে প্রাপ্য ২৯০০ কোটি টাকা কেটে নিয়েছে কেন্দ্র।”
বিক্রয় করের ভাগ কম দেওয়া নিয়ে অভিযোগের জবাবে অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে কোনও বঞ্চনা করা হচ্ছে না। রাজ্য যে হেতু ভ্যাট আদায় করে, তাই কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর বাবদ আয় কম হয়। জিএসটি চালু করার জন্য কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের হার কমানো হয়েছে। তার পরে পশ্চিমবঙ্গ ভ্যাটের হার ৪ থেকে বাড়িয়ে ৫% করেছে। সেই হিসেবে রাজ্যের আয়ের সুযোগ বেড়েছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর বাবদ আয়ও কমেছে। সেই হিসেব করেই রাজ্যের পাওনা থেকে একটি অংশ নিয়মমাফিক বাদ দেওয়া হয়।
কেন্দ্র-রাজ্য এই চাপানউতোর অবশ্য নতুন নয়। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার অভিযোগ তোলার ইতিহাস সেই জ্যোতি বসুর আমল থেকেই। ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরে বছরখানেক দিল্লির বিরুদ্ধে তেমন সরব হয়নি মমতার সরকার। কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভাঙার পর থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে দিল্লির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের দাবি জানাতে দিল্লিতে ধর্নাও দিয়েছেন শাসক দলের সাংসদরা।
রাজ্যের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তুলেছে কেন্দ্রও। গ্রামে পাকা সড়ক তৈরি থেকে জল সংরক্ষণ, ১০০ দিনের কাজ থেকে ইন্দিরা আবাসের বাড়ি তৈরি প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজ্যের ব্যর্থতা চিহ্নিত করে জবাবদিহি চেয়েছেন জয়রাম।
১০০ দিনের কাজে সাফল্য যে গত বছরের তুলনায় অনেকটাই কম, তা অবশ্য মানেন রাজ্যের কর্তারাও। গত বছর প্রায় ২০ কোটি শ্রমদিবস তৈরি করে ৪০০০ কোটি টাকা খরচ করেছিল রাজ্য। প্রতিটি পরিবার গড়ে ৩২ দিন করে কাজ পেয়েছিল। এ বার এখনো পরিবারপিছু গড়ে ২০ দিনও কাজ দেওয়া যায়নি। কর্তাদের অবশ্য যুক্তি, পঞ্চায়েত ভোটের জন্য পাঁচ মাস কোনও কাজ হয়নি। কিন্তু এখন কাজের সময় কেন্দ্র টাকা দিচ্ছে না।
শিয়রে লোকসভা ভোট। এবং কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের ইঙ্গিত এখনও নেই। এই অবস্থায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মমতার সরকার আরও সুর চড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। লোকসভা ভোটের প্রচারে বিভিন্ন রাজ্যে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন কেন্দ্র-বিরোধী সুর চড়িয়ে তিনি অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দলগুলিকে কাছে টানার চেষ্টা করবেন বলে তৃণমূল সূত্রে খবর।
|
বঞ্চনার ফর্দ |
বিষয় |
রাজ্য চেয়েছিল |
কেন্দ্র দিয়েছে |
১০০ দিনের কাজ |
১২০০ কোটি |
১০০ কোটি |
গ্রামীণ সড়ক |
৪৫০০ কোটি |
কিছুই মেলেনি |
কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের ভাগ |
প্রাপ্য ১৮০৪ কোটি |
১৩৭৯ কোটি |
|