ছোটোখাটো অস্বস্তি, বিতর্ক ছিলই। কিন্তু অরবিন্দের সংসারে এ বার সরাসরি বিদ্রোহের ঝড়।
আজ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছেন আম আদমি পার্টির (আপ) বিধায়ক বিনোদ বিন্নি। অরবিন্দের নেতৃত্ব থেকে প্রশাসনিক দক্ষতা, সব কিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলে পূর্ব দিল্লির এই বিধায়কের অভিযোগ, উনি স্বৈরতান্ত্রিক নেতা। অন্য কারও কথা শুনতেই চান না। নতুন সরকারের একাধিক পদক্ষেপেরও কড়া সমালোচনা করেছেন বিন্নি।
যা শোনার পরে তড়িঘড়ি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মুখ খুলতে হয়েছে আপ-এর অন্যতম নেতা যোগেন্দ্র যাদবকে। যোগেন্দ্রর বক্তব্য, বিন্নি আদতে বিজেপির ইশারাতেই চলছেন এবং সে কারণেই তিনি এ ধরনের কথা বলছেন।
বিন্নি অবশ্য একা নন। দলের নেতাদের একাংশের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পাশাপাশি দলের একাধিক নীতি নিয়েও ইতিমধ্যেই ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ খুলতে শুরু করেছেন একাধিক আপ বিধায়ক। এমনকী দলে সদ্য যোগদান করা ক্যাপ্টেন গোপীনাথও দলের নীতি নিয়ে প্রকাশ্যেই সরব হয়েছেন। গোপীনাথ গতকালই বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি নিয়ে দলের নীতির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। এখানেই শেষ নয়। আপ সূত্রে খবর, দলের অন্তত চার-পাঁচ জন বিধায়কের সঙ্গে বিজেপি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখছে। সে ক্ষেত্রে দল তো বটেই, আগামী দিনে কী ভাবে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখা যাবে, তা নিয়েও চিন্তার ভাঁজ দলের নেতাদের কপালে।
এক কথায় ঘোর অশান্তির হাওয়া আপ-এর সংসারে।
অথচ রাজনীতিতে অন্য ধারা, ভিন্ন ধরনের প্রশাসনের স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করে ছিলেন অরবিন্দরা। কিন্তু এখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকে মনে করছেন, প্রতিষ্ঠিত দলগুলির মতোই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের চেনা ছকে হাঁটতে শুরু করেছে আপ-ও। যে কারণে গদিতে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এত সমস্যা গ্রাস করছে তাদের। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে অন্তর্কলহ। ফলে দল তৈরি হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যেই জাতীয় রাজনীতিতে সাড়া ফেলে দেওয়া আপ-এর ভবিষ্যৎ কী, সে প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে।
এমনিতেই গত ক’দিন ধরে একের পর এক বিতর্কে এবং সমস্যায় জেরবার আপ নেতৃত্ব। জনতা দরবার বাতিল করা নিয়ে অস্বস্তি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই রাজধানীতে এক বিদেশি মহিলা ধর্ষিতা হওয়ার ঘটনা এবং তা নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নীরবতা বিরোধীদের হাতে বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরেও। তবু এ সব ছাপিয়ে গেল বিনোদ বিন্নির প্রকাশ্য বিদ্রোহ। আজ অরবিন্দ-সহ শীর্ষ আপ নেতৃত্বকে বিন্নি সরাসরি কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আধ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক বৈঠক ডাকতে বাধ্য হন আপ নেতৃত্ব। যা শেষ হতে না হতেই ফের মুখ খোলেন বিন্নি! এই পরিস্থিতিতে সমালোচনার ঢেউ সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত ময়দানে নামতে বাধ্য হন অরবিন্দ নিজে। আপ-এর অন্দরে কোন্দল অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের এই পারস্পরিক তরজা দেখে এক বিজেপি নেতার সরস মন্তব্য, “মনে হচ্ছে ব্যাডমিন্টন খেলা দেখছি! শাটল কক একবার
এর কোর্টে তো পর মুহূর্তে অন্য কোর্টে!” আপ নেতৃত্বকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন বিজেপির শীর্ষ নেতা অরুণ জেটলিও। তাঁর বক্তব্য, যা হচ্ছে, তা স্রেফ চমক এবং এর হাত ধরে পরিস্থিতি ক্রমশ স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে।
আজ কী বলেছেন বিন্নি?
এই আপ বিধায়কের বক্তব্য, “দল প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসায় আমায় মুখ খুলতে হল।” দিল্লিবাসীকে ৭০০ লিটার জল, বিদ্যুতের দাম অর্ধেক করে দেওয়ার মতো যে সব জনমোহিনী সিদ্ধান্ত আপ নেতৃত্ব নিয়েছেন, তার অধিকাংশই লোক ঠকানো বলে অভিযোগ করে আজ কার্যত বিজেপির সঙ্গেই সুর মিলিয়েছেন তিনি। বিন্নির অভিযোগ, “এর একটিও বাস্তবে রূপায়িত হওয়ার আগেই লোকসভা নির্বাচন চলে আসবে। আম আদমির কোনও ফায়দা হবে না।”
শুধু নীতির প্রশ্নে নয়, আজ ব্যক্তি অরবিন্দকে ‘স্বৈরাচারী’ বলতেও ছাড়েননি বিন্নি। তাঁর ব্যাখ্যা, “মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও দলে অরবিন্দই শেষ কথা। তাঁর উপরে কেউ কথা বলতে পারেন না।” একই সঙ্গে অরবিন্দের সঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের ছেলে সন্দীপের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়েও সরব হয়েছেন বিন্নি। তাঁর বক্তব্য, কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার চালাচ্ছেন অরবিন্দ। তাই পূর্বতন সরকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে অনাগ্রহী তিনি।
বিন্নি মুখ খোলার পরেই তড়িঘড়ি বৈঠকে বসেন আপ নেতৃত্ব। আধ ঘণ্টার মধ্যে সাংবাদিক বৈঠক করে আপ নেতা যোগেন্দ্র যাদব বলেন, “বিন্নির বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তাঁর অভিযোগ, “বিন্নি আসলে বিজেপির ইশারায় ওই কাজ করছেন।” কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রশ্নে যোগেন্দ্রের জবাব, “তদন্ত শুরুর আগে প্রমাণ জোগাড় করতে হয়। এখন সেই কাজ চলছে। ঠিক সময়ে তদন্ত শুরু হবে।”
মহিলাদের সুরক্ষা প্রশ্নেও আজ অরবিন্দ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খোলেন বিন্নি। ডেনমার্কের এক মহিলার ধর্ষণের ঘটনা সামনে আসার পর সেই দায় দিল্লি পুলিশ তথা কেন্দ্রের ঘাড়ে ঠেলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। আজ বিন্নি প্রশ্ন তোলেন, “এই ঘটনা আগের সরকারের আমলে ঘটলে এতক্ষণে রাস্তায় নেমে সরকারের মুণ্ডপাত শুরু করে দিতেন আপ নেতৃত্ব। এখন কোথায় তিনি?” একই কথা আজ বলেছে কংগ্রেসও।
এ ব্যাপারে অরবিন্দকে সরাসরি বিঁধে কংগ্রেসের হুমকি, মহিলাদের উপরে নির্যাতন বন্ধ না হলে তারা রাস্তায় নামবে। এক বছর আগে, ঠিক এই ভাষাতেই কংগ্রেসের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে হুমকি দিয়েছিলেন অরবিন্দ ও তাঁর সঙ্গীরা!
বিদেশিনি গণধর্ষণের ঘটনায় চুপ থেকে এমনিতেই সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন অরবিন্দ। তার উপর এ দিন বিন্নির তোপ। তার সঙ্গে এ দিনই যোগ হয় দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে দলের দুই মন্ত্রীর প্রকাশ্য ক্ষোভ। গতকাল রাতে দিল্লির মালব্যনগর ও সুন্দরনগরে নারী নির্যাতন ও যৌন ব্যবসা আটকাতে পুলিশের হস্তক্ষেপ চান আপ-এর দুই মন্ত্রী রাখি বিড়লা ও সোমনাথ ভারতী। কিন্তু তাঁরা আজ অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁদের কথা শুনে পদক্ষেপ করতে রাজি হয়নি! এই পরিস্থিতিতে এ দিন মুখ খুললেন অরবিন্দ। রাজধানীর পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ অরবিন্দের বক্তব্য, দিল্লি পুলিশের মানসিকতা না বদলালে রাজধানীতে ধর্ষণ কোনও দিনই কমবে না। ক্ষিপ্ত কেজরিওয়াল বলেন, “পুলিশ যদি নারী নির্যাতন রুখতে এগিয়ে না আসে, তা হলে ধর্ষণ হবেই। অকর্মণ্য পুলিশের কারণেই দিল্লিতে ধর্ষণ ঘটছে।” কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে অরবিন্দ আগামিকাল লেফটেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জং-এর সঙ্গে দেখাও করতে চলেছেন। কেজরিওয়ালের অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন দিল্লির পুলিশ কমিশনার বি এস বাসি। তাঁর দাবি, “দিল্লির পুলিশ রাজধানীবাসীকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম।”
‘দিল্লি পুলিশ, তুমি কার’ আসলে এই বিতর্ক বহু পুরনো। এর আগে নির্ভয়া-কাণ্ডের সময় শীলা দীক্ষিত প্রশাসনও ঘটনার দায় কেন্দ্রের উপর ঠেলে দিয়েছিল। বিন্নি এবং বিজেপি নেতৃত্বের অভিযোগ, এ বার সেই পথেই হাঁটছে অরবিন্দের প্রশাসন। যা দেখে বিজেপির মুখপাত্র নির্মলা সীতারামনের মন্তব্য, “আপ বলেছিল তারা অন্য রাজনৈতিক দলগুলি থেকে আলাদা। কার্যক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টোটা হচ্ছে।” |