|
|
|
|
এত দ্বিধা এত ভান কেন
|
প্রশ্ন তুললেন অর্পিতা ঘোষ ও দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। |
বিভাগীয় সম্পাদক
আনন্দplus |
সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘নাট্যপরিচালকের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ’ প্রসঙ্গে সুমন -বিপ্লব -কৌশিকের ‘আশঙ্কা হচ্ছে’ শীর্ষক পত্র ও পরবর্তীতে ‘না দেখেই নগ্নতায় থুতু কেন’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে সুমন ও কৌশিকের আবারও প্রতিক্রিয়া পড়লাম।
প্রথম পত্রে ‘ত্রয়ী’ শ্যামল ভট্টাচার্যের সমালোচনা করার ‘সুযোগ ও স্বাধীনতা’ দাবি করেছেন, ‘সত্য’ উন্মোচনেরও দাবি করেছেন এবং শ্যামলবাবুর ফেসবুকের মন্তব্যকে সমর্থন করে বলেছেন, “শিল্পচর্চার নানা প্রয়োগপদ্ধতি নিয়েও প্রবল সমালোচনা হয়, এটাই সুস্থ স্বাভাবিক ঘটনা।” সুতরাং বোঝা গেল ‘ত্রয়ী’ শ্যামলবাবুকে সিরিয়াসলি নিয়ে তাঁর পক্ষে সমর্থন করে মণীশকে সমালোচনা করেছেন।
|
দেবেশ চট্টোপাধ্যায় |
অর্পিতা ঘোষ |
|
তার কয়েক দিন পরেই আবার সাক্ষাৎকারে কৌশিক বলেছেন, “এ নাগাদ শ্যামল ভট্টাচার্য -র কোনও ফেমাস প্রোডাকশন নেই। সেই ভদ্রলোক যদি নাটকটা না দেখে কমেন্ট করে বসেন, তাঁকে এত সিরিয়াসলি মণীশ নেবেন কেন?” মজা পেলাম কথাটা শুনে যে, শ্যামলবাবুকে ‘সিরিয়াসলি’ নিয়ে, তাঁর পক্ষ সমর্থন করে ‘ত্রয়ী’ মণীশকে আক্রমণ করে পত্র লিখলেন, সেই শ্যামলবাবুকেই আবার তিনি ‘সিরিয়াসলি’ না নিতে মণীশকে উপদেশ দিচ্ছেন? কেন এই দ্বিচারিতা? ত্রয়ী নিশ্চয়ই জানতেন ফেসবুকে নাটক না দেখে শ্যামলবাবু যে ভাষায় মণীশকে আক্রমণ করেছেন তা উদ্দেশ্য -প্রণোদিত।
তাঁরা শ্যামলবাবুর সমালোচনা করার ‘সুযোগ ও স্বাধীনতা’ যখন দাবি করছেন, তখন নিশ্চয়ই শ্যামলবাবুর ফেসবুকের বক্তব্যও সমর্থন করেন। আর করেন বলেই তাঁরা পত্রাঘাত করতে পারেন। ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘ধর্ষক’ শব্দবন্ধ ছাড়াও শ্যামলবাবু কী লিখেছিলেন ফেসবুকে?
১ ) থিয়েটারে পর্নো আনার চেষ্টা চালাচ্ছে কিছু পরিবর্তনী দুর্বৃত্ত। ...পরিবর্তনের এই লীলাখেলা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? একটু ভাবুন আর সক্রিয় হোন এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে।
২ ) এরা নগ্ন করতে চায় বাংলা থিয়েটারের সমস্ত গৌরবময় ঐতিহ্যকে। আসুন প্রতিবাদ করি, প্রতিরোধ করি এই সব নষ্টামির বিরুদ্ধে।
৩ ) আবার নাটক ছেড়ে নগ্নতা নিয়ে হইচই হোক এটাই ওই দুর্বলতম নাট্যপ্রযোজক, পরিচালক এবং পরিবর্তনী বুদ্ধিজীবীর উদ্যোগ। ...আমরা দারুণ ভাবে সজাগ, কারণ যুদ্ধ আসন্ন এই দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে, যাঁরা বাংলা সংস্কৃতির জননীদের নগ্ন করতে চাইছে। শুধু মনে রাখুন আপনার নীরবতা কিংবা দোদুল্যমানতা এই সংস্কৃতির খুনিদের আয়ু বাড়াবে। আর এদের আয়ু বাড়া মানে আপনার পরিবারের সুস্থ চিন্তার মৃত্যু ঘটানো।
|
|
হুমকিতে ভরা এই অশালীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্যকে এরা যেহেতু ‘সুস্থ স্বাভাবিক’ ঘটনায় অভিহিত করে সমর্থন করেছেন এবং একই সঙ্গে ‘বাংলা থিয়েটারের কিছু মানুষের মধ্যে এক রকমের অসহিষ্ণুতা দেখা যাচ্ছে’ বলে গায়ে নিরপেক্ষতার খোলস চাপিয়েছেন, তা বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে দ্বিচারিতার চূড়ান্ত নিদর্শন হয়ে থাকবে। মধ্য মেধার রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে শ্যামল ভট্টাচার্যকে তা -ও বোঝা যায়। কিন্তু এই ত্রয়ীকে বোঝা যায় না। ত্রয়ীর অন্যতম সুমন ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’কে নিন্দে করে নিজেই অন্য ব্যক্তিকে আক্রমণ করেন। আবার কৌশিকের যাবতীয় সামাজিক বিপ্লবের সবটাই ‘ব্যক্তিগত’ এবং বিপ্লবের ‘বিপ্লব’ বোধ হয় ক্রমশ প্রকাশ্য। ত্রয়ী ‘সত্য’ উন্মোচনের কথা বলেছেন। একটি ছোট্ট সত্য -র কথা বলি। সুমন বর্তমানে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের গ্রান্ট কমিটিতে আছেন। তাঁর নিজের দল ‘তৃতীয় সূত্র’ দীর্ঘ দিন ধরেই নিষ্ক্রিয়। যদিও দলটি ছ’জন শিষ্য ও একজন গুরুর অর্থ পেতেন। বিভিন্ন দল থেকে ছেলেমেয়ে জোগাড় করে অন্য দলের সহযোগিতা (শ্যামবাজার মুখোমুখি ) নিয়ে যখন ‘মেফিস্টো’ করেন, সেই সময়ই নিজের দলের গ্রান্ট সুমন ৬ জন থেকে ১৮ জনে বাড়িয়ে নিয়ে যান। আবার অঙ্কের নিয়মে এই সহযোগী দল শ্যামবাজার মুখোমুখি -র প্রযোজনা ‘তিন কন্যার’ প্রশস্তি করেন সংবাদপত্রে। সঙ্গে থাকে সরকার বিরোধী আনুগত্যের তাড়না থেকে প্রাণিত কৌশিক সেনের ‘থানা থেকে আসছি’। এই দ্বিচারিতা ভরা ‘সত্য’কে সুমন কি ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ বলবেন? গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে ‘পরিবর্তন চাই’ শীর্ষক হোর্ডিংয়ে ছাপার জন্য নিজের ছবি মেল করে পাঠানো ও সম্মতিপত্রে সই করা এবং তার পরেই তা নিয়ে আপত্তি জানানোর দ্বিচারিতা নিয়ে কোনও কথা বলা কি ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’?
হঠাৎ একটা পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। ২০০৪ সালে সুমনের ‘তৃতীয় সূত্র’ আর ‘পঞ্চম বৈদিক’ থিয়েটারের কারণে একটি যৌথ প্ল্যাটফর্ম স্থাপন করেছিলেন ‘পূর্ণতরঙ্গ’ নাম দিয়ে। ‘পঞ্চম বৈদিক’ চেয়েছিল সেই প্ল্যাটফর্মে কৌশিক ও ব্রাত্যকেও যুক্ত করতে। সুমন দু’টি অজুহাত দিয়েছিলেন কৌশিক আদ্যন্ত সিপিআই (এম ) পার্টির কথায় ওঠে -বসে আর ব্রাত্য যৌথতায় বিশ্বাস করে না। সময়ের কী অদ্ভুত পরিহাস, ২০১৩ সালে আদ্যন্ত সিপিআই (এম ) কৌশিকের হাত ধরলেন সুমন আর যৌথতায় অবিশ্বাসী ব্রাত্য -র পরিচালনায় গড়ে উঠল একটি সংগঠননাট্যস্বজন। এই রকম অসংখ্য ‘সত্য’ ত্রয়ীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে -ছিটিয়ে রয়েছে। সেটা নিরপেক্ষতার ভান দিয়ে ঢাকা যায় না।
কেনিথ টিন্যান নামে একজন ব্রিটিশ নাট্যসমালোচক ষাটের দশকে জ্যাকস লেভি নামে এক নাট্য পরিচালককে মঞ্চে নগ্নতার সীমারেখা বোঝার জন্য একটি নাট্য নির্মাণ করতে বলেন। সেই নাটক রচনার জন্য হাত মিলিয়েছিলেন স্যামুয়েল বেকেট, জন লেনন, জুলিয়েস ফিফার, স্যাম শেপার্ডের মতো ব্যক্তিত্বরা। ১৯৬৯ -য়ে আমেরিকার অফ ব্রডওয়েতে প্রিমিয়ার হয় সাফল্যের সঙ্গে। নাটকটির নাম ‘ওহ্ ক্যালকাটা’! মঞ্চে নগ্নতার ইতিহাসে স্মরণীয় ওই প্রযোজনাটি ব্রডওয়েতেও সমান জনপ্রিয় হয়।
এর কাছাকাছি সময়ে ১৯৬৮ -তে রয়্যাল শেক্সপিয়ার কোম্পানি ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘ডা . ফাউস্ট’ প্রযোজনা করে। মঞ্চে ম্যাগি রাইট হেলেন অব ট্রয় -য়ের ভূমিকায় নগ্ন হয়ে প্রবেশ করতেন।
এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে যেখানে নগ্নতা শিল্পের স্বার্থে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আর ভারতবর্ষের শিল্পের ঐতিহ্যে নগ্নতাকে আলাদা ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কখনও। তা এসেছে স্বাভাবিক ভাবেই। শিল্পের ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
‘ভারতীয় সংস্কৃতিতে যৌনতা কিছু যুক্তি -তক্কো -গপ্পো ! ’তে সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, “যতই আমরা আমাদের অতীত সভ্যতার বড়াই করি, কোনারক -খাজুরাহো, বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’র বিজ্ঞাপন বিলি করে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করি, শিল্প -কর্মের গুণাবধারণে আমরা এখনও সেই অতীতের উপনিবেশিক শিক্ষাপ্রসূত ভিক্টোরীয় রক্ষণশীল যৌনচিন্তাধারাতে আচ্ছন্ন।”
‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’ বা ‘দর্জিপাড়ার মর্জিনা’র পরিচালকরা আশা করি শ্যামল ভট্টাচার্যের মতো যৌন চিন্তাধারাতে আচ্ছন্ন নন। তা হলে তাদের ‘আচ্ছন্নতা’ যে রাজনৈতিক ভূমিতে পথ খুঁজে নিচ্ছে তা প্রকাশ করতে এত দ্বিধা, এত ভান কেন? মণীশ এই সময়ের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক। যে আবেগের সঙ্গে জোরের সঙ্গে সে এই প্রযোজনা মঞ্চস্থ করেছে, আমরা আশা রাখি সমান জোরের সঙ্গে এই প্রযোজনা বাংলা নাট্যের স্বার্থে নিয়মিত অভিনয় করবে ‘অর্ঘ্য’। |
|
|
|
|
|