|
|
|
|
না দেখেই নগ্নতায় থুতু কেন |
প্রথম শোয়ের পরেই থানা-পুলিশ! সুমন-বিপ্লব-কৌশিকের চিঠি। তার পর ঘেন্না থেকেই নাকি
বন্ধ করে দিচ্ছেন নাটক। এমনটাই বলছেন পরিচালক মণীশ মিত্র। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত। |
ব্লাড প্রেশার কত?
হা হা হা হা হা। ১১০/৮০।
কবে মেপেছিলেন?
নভেম্বরে।
যদি কেউ বলে ‘শেক্সপিয়রস ট্র্যাজিক হিরোজ: ওথেলো, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট...’ বন্ধ করার সিদ্ধান্তটা একটা পাবলিসিটি স্টান্ট?
হ্যাঁ, পাবলিসিটি স্টান্ট বলতে পারেন। নাটকটা না দেখেই অনেকে আমাকে ‘ধর্ষক’ বলেছে। আমাদের হাতে নাকি ব্লু থিয়েটারের জন্ম হল বলেছে। আবার তাঁদের সঙ্গে যখন ট্র্যাজেডি নিয়ে কথা বলতে চাওয়া হয়েছে, ট্র্যাজেডির তাৎপর্য জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তখন তাঁরা একেবারেকেটে পড়েছেন। তাই সম্পূর্ণ অশিক্ষিত একদল লোক পাবলিসিটি স্টান্ট বললে আমাদের সত্যি কিছু এসে যায় না। আমাদের কাছে থিয়েটার একটা জীবনচর্চা। সামগ্রিক ভাবে এবং গভীর ভাবে আত্মস্থ হয়ে সেই কাজ করতে চাই। সেই ঘোরে যখন ছেদ পড়ে, তখন ভয় নয়, খানিকটা ঘেন্নায়, আর খানিকটা শান্ত প্রতিবাদে সরে যেতে ইচ্ছে করে।
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কেউ আবার ঘেন্না নিয়ে ফিরে যায় নাকি?
হ্যাঁ, যায় বইকী। যখন মনে হয় যে এই কৌশিক সেন আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাপসী মালিকের জন্য মেকি চোখের জল ফেলেছিলেন, তখন ঘেন্না হয় বইকী। সাড়ে চার বছরের অধ্যবসায়ে, ছ’ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের একটা নাটক যখন নির্মাণ করেছিলাম, এবং সেই ছ’ঘণ্টা যখন দর্শকের বিরক্তির উৎপাদন ঘটায়নি, তখন এটা তো বুঝতে পারছেন যে আত্মস্থ হয়েই কাজটা করি। অর্ঘ্য-র ঐতিহ্যে, আমার নিজের জীবনচর্যায় কোথাও পাবলিসিটি স্টান্ট নেই। আমাদের বিজ্ঞাপনগুলোয় সচরাচর আমার নাম থাকে না। নিরর্থক কোলাহলের ভিড়ের মধ্যে নিজেদের কাজ স্থাপন করতে অনীহা হচ্ছে।
এই নাটকের হোর্ডিংয়ে তো আপনার নাম আছে?
চারটে হোর্ডিংয়ের মধ্যে একটাতে ভুল করে আমার নাম গিয়েছে। কিন্তু নিয়মিত যে বিজ্ঞাপন হয়, বা অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহের দরজায় যে বিজ্ঞাপন আছে, সেখানে আমার নাম খুঁজে পাবেন না। আমি কার্টেন কল-য়ে দর্শকের অনুরোধ ছাড়া নিজের নাম উচ্চারণ করি না। আমি বলছি না আমরা প্রচারবিমুখ। কিন্তু সেই প্রচারের জন্য কোনও সস্তার পথ নেওয়ার ইতিহাস আমাদের নেই।
আপনার নিন্দুকেরা তো বলছেন যে নাটকটা অনেকের ভাল লাগেনি বলেই এমন সিদ্ধান্ত আপনি নিয়েছেন। দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন বাঙালির অসহিষ্ণুতার ওপর...
আসলে এই নাটকটার নতুন রূপে অভিনয় হয়েছে মাত্র একটা শো-তে। সেটা গিরিশ মঞ্চে। তার পরেও বৃহস্পতিবারের অভিনয়ের আগেই প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। ফলে দর্শক নাটককে রিজেক্ট করেছে এই সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নেওয়া যায় না। মজার কথা কী জানেন, যখন ‘উরুভঙ্গম’-য়ের জন্য হাউসফুল থাকছে, তার সঙ্গেই ‘প্রেমাণি বোল’ বলে একটা নাটক করি, যেটার জন্য হয়তো হলে বড়জোর ২০ থেকে ৩০ জন থাকেন। তবু সে নাটকটা বন্ধ করিনি। এই অপপ্রচারের মানে হয় না।
নাটকে নগ্নতা ব্যবহার করার সময় নিশ্চয়ই জানতেন যে বিতর্ক সৃষ্টি হবে। তা হলে কেন পিছিয়ে যাচ্ছেন?
আসলে যাঁরা নাটকটা দেখেছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তাঁরা মঞ্চে ন্যুডিটি নিয়ে কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি। আসলে যাঁরা থুতু ছিটিয়েছেন, তাঁরা কেউই নাটকটা দেখেননি। শ্যামল ভট্টাচার্য আমাকে ফেসবুকে ‘দেশদ্রোহী’ এবং ‘ধর্ষক’ বলে অভিহিত করেছেন। তাও নাটকটা না দেখে। সেই কথার সমর্থনে সুমন মুখোপাধ্যায়, কৌশিক সেন এঁরা নাটকের সমালোচনা বলে সেই শব্দগুলোকে সহজে মেনে নিতে বলছেন যেখানে এঁরা কেউই নাটকটা দেখেননি। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাট্যকর্মীর পক্ষে এ ধরনের শব্দপ্রয়োগ কি সুস্থতার লক্ষণ? আমার সম্পর্কে খুন করার হুমকির যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্ত হোক।
|
|
নাটকের ‘ওথেলো’ অংশে সেই বিতর্কিত নগ্নতার দৃশ্য। |
|
আপনিও তাই চাইছেন?
হ্যা। কিন্তু কৌশিক, সুমন, বিপ্লবদের উদ্দেশ্য সৎ হলে প্রাথমিক ভাবে ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘ধর্ষক’ শব্দগুলো যে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ, সেটা তাঁরা নিঃসঙ্কোচে বলতেন। সুমনের জীবনের প্রথম নাট্যগুরু এবং তাঁর বাবা আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় অরুণ মুখোপাধ্যায় নাটকটা দেখেছেন। ব্যাকস্টেজে এসে দেখা করেছেন। ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘ধর্ষক’ বলেননি। ভেবেছিলাম যে এই নির্বোধ, অশিক্ষিত মানুষেরা একদিন থুতু ছেটাতে ছেটাতে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু পীড়িত হলাম এই দেখে যে আমাদের প্রতি এই নিরর্থক, ভয়ঙ্কর আক্রমণের পাশে কোমর বেঁধে দাঁড়ালেন এই সময়ের তিন জন সম্মাননীয় নাট্য পরিচালক। খুব কষ্ট লাগে ভেবে যে ফেক প্রোফাইল তৈরি করে ফেসবুকে গালি দেওয়াতেই থেমে থাকেননি অনেকে। ফোন করে জিজ্ঞেস করছেন, নোয়া-র (ডেসডিমোনার ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছেন) রেট কত যাচ্ছে? নাম্বারটা চাইলে দিতে পারি। বলুন তো আমি এ বার কোন মুখ নিয়ে নোয়ার সামনে দাঁড়াব?
‘ছত্রাক’য়ের ক্ষেত্রেও তো গোটা সিনেমাটা না দেখে শুধুমাত্র একটা লিক হয়ে যাওয়া ক্লিপের ভিত্তিতেই প্রতিবাদ করেছিলেন অনেকে। আপনি তখন কোন দিকে ছিলেন?
বিষয়টা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম না যেহেতু সিনেমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ কম। কিন্তু ওই সিনেমার বিতর্কিত অভিনেত্রীর সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক উক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছি। নিজের ক্ষেত্রে তা হলে আমরা সমস্যাটা বেশি করে বুঝতে পারি।
শুধুমাত্র চার জন নাট্যকর্মীর কথার জন্য এত বড় একটা স্টেপ? সুমন, বিপ্লব, কৌশিকের চিঠিতে আপনার নাটকের বিরুদ্ধে কথা বলা নেই...
থিয়েটারের কাজ সামাজিক সাম্য তৈরি করা। সেখানে যদি আমার কাজকে ঘিরে মানুষের মনে এত অসন্তুষ্টি তৈরি হয় তা হলে তা একটা সংগঠিত আক্রমণের ফলাফল হিসাবেই ঘটেছে। সাময়িক ভাবে সরে দাঁড়ানোটাও একটা কঠিন অথচ প্রবল প্রতিবাদ। এই যে আমরা কয়েক জন সমমনোভাবাপন্ন মানুষ ভাল নাটকের জন্য একত্রিত হয়েছি, নাট্যস্বজন গঠিত হয়েছে, তাতে বোধ হয় কারও কারও ঘুঘুর বাসায় ঢিল পড়ার ভীতি তৈরি হয়েছে। আর তাই তাঁদের নিজেদের অসহিষ্ণুতার দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন।
|
সুমন মুখোপাধ্যায়
|
“নাটকের ‘ওথেলো’ অংশে সেই বিতর্কিত নগ্নতার দৃশ্য
এখন বাংলা থিয়েটার
যে ভাবে চলছে, সেটা আমার কাছে অভিপ্রেত নয়। কেমন দলাদলি, ভাগাভাগি
হয়ে গিয়েছে। সেটা আগেও ছিল। তবে এখন যেন সব্বাই তলোয়ার-বন্দুক নিয়ে
বেরিয়ে এসেছে। সমালোচনা হতেই পারে, কিন্তু এখন ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে।
আমি মণীশের নাটকটা দেখিনি। ওটা বন্ধ হচ্ছে কেন, তা-ও জানি না।
তবে যে কোনও নাটক বন্ধ হয়ে যাওয়াটা অভিপ্রেত নয়।”
|
ব্রাত্য বসু |
“এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। মণীশ আমার নাট্যস্বজন। এই সময়কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
পরিচালক ও। সারা ভারতে ওকে চেনে। কিছু লোক আমাদের নাট্যস্বজন-য়ের পরিচালকদের
টার্গেট করছেন। নানা ভাবে তাদের নামে কুৎসা করছেন। আর যা সামগ্রিক ভাবে
থিয়েটার চর্চার পক্ষে ক্ষতিকর। আমি মণীশকে ব্যক্তিগত ভাবে অনুরোধ করছি
এদের কথায় প্ররোচিত না হয়ে, সিদ্ধান্ত যেন পুনর্বিবেচনা করেন।” |
কৌশিক সেন
|
“এ নাগাদ শ্যামল ভট্টাচার্যর কোনও ফেমাস প্রোডাকশন নেই। সেই ভদ্রলোক যদি নাটকটা
না দেখে কমেন্ট করে বসেন, তাঁকে এত সিরিয়াসলি মণীশ নেবেন কেন? মণীশও কিন্তু
একটা কাগজে বলেছিলেন যে ম্যাকবেথের ট্র্যাজেডি কৌশিক কিচ্ছু বোঝেননি।
তার জন্য আমি ওঁকে ভোরবেলায় ফোন করিনি। বা ম্যাকবেথ বন্ধ করিনি।
কোনও কমেন্ট শুনে আমার মতামতে আমি স্থিত থাকব না কেন?”
|
|
আপনি তো প্রায়ই একে ৪৭ চালান। কথা বলা শুরু করেন এই দিয়ে যে অমুক নাটক বোঝেননি। কেউ হয়তো এখন মুচকি মুচকি হেসে বলেছেন, “দ্যাখো কেমন লাগে...”
‘মেফিস্টো’ দেখে সুমন (মুখোপাধ্যায়)কে আমার নতজানু হয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে হয়েছে। আমি ‘জার্নি টু ডাকঘর’ নির্মাণ করতে পারতাম না যদি কৌশিকের ‘ডাকঘর’টা না দেখা থাকত। কখনও কারও কাজ দেখে ‘প্রি-কনসিভড’ ডগমা থেকে মতামত দিইনি। কখনও ভাল, কখনও মন্দ। খোলা মনে বলেছি....
কেন মেনে নিতে পারছেন না যে অন্যান্যরাও খোলা মনে বলেছেন...
নিশ্চয়ই বলতে পারেন নাটক দেখার পরে। তাও ‘ধর্ষক’ বা ‘দেশদ্রোহী’ শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারেন না।
আপনি এই শব্দগুলো না ব্যবহার করে নিজেও বেশ কড়া সমালোচনা করে থাকেন। কেউ কেউ তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ বলে মনে করেন...
আমি ‘ম্যাকবেথ’ বা ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’য়ের শৈল্পিক বিষয়ের বাইরে একবারই কথা বলেছি। সেটা ‘রাজা লিয়র’য়ের ব্যালান্স শিটটা হাতে পেয়ে। মিনার্ভা রেপার্টরির দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আমিও প্রযোজনার বিপুল ব্যয়ভার দেখে বিমূঢ় হয়েছিলাম। ওই রেপার্টরির কর্মীরা (শিল্পীরা নয়) মাত্র পাঁচ হাজার- ছ’হাজার টাকা বেতনে প্রায় বিনা ছুটিতে কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। আর তাঁদের সাহায্য নিয়ে এত খরচ করা হয়েছে একটা প্রযোজনায়। পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা গরিব রাজ্যে এত টাকা খরচা করে করদাতাদের পয়সায় থিয়েটারে এমন ঘটতে পারে ভেবে
কষ্ট হয়েছিল। তথ্য এবং অঙ্ক দিয়ে
তাই বলেছিলাম, থুতু ছিটাইনি।
আজও সুমনের ‘গন্তব্য’ থেকে ‘মেফিস্টো’ নিয়ে কোনও নাটকের সম্পর্কে বিরূপ কথা উঠলে ওর স্তাবকের মতো ঝগড়া করব।
উনি আপনার মতো রগচটা নাট্যকর্মীকে স্তাবক হিসেবে চান কি না তা জানা নেই...
কেন রগচটা বলছেন? ফেসবুকে সে রকম কোনও কমেন্ট কি আমি করেছি? সত্যি কথা সহজ ভাবে বলার ক্ষমতা তো থাকা উচিত।
আপনি কি অস্বীকার করছেন যে আপনি খুব সহজেই রেগে যান?
আমি আবেগপ্রবণ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করি। ওদের যাতে নিরর্থক মানসিক চাপ তৈরি না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব আমার। আমি ওদের সম্পর্কে প্রোটেকটিভ।
শেষ প্রশ্ন আপনি প্রেশারটা এ বছরে মাপাবেন না?
আগে আমার আন্দোলনকারী থিয়েটার বন্ধুদের স্বরূপ প্রকাশিত হোক। তার পর ব্লাড প্রেশারটা মেপে নেব। |
|
|
|
|
|