শুরু হল নতুন বছর। খ্রিস্টাব্দ, বঙ্গাব্দ বা শকাব্দ নয়, নয় কোনও ভিন দেশের নতুন বছর। নয় কোনও সরকারি কর্মসূচিও। ১ মাঘ থেকে শুরু হল নতুন কৃষিবর্ষ। সদ্য মাঠ থেকে তোলা ধান আগামী বছর কী ভাবে মেপে মেপে খরচ করা হবে, গৃহস্থ সেই পরিকল্পনা তৈরি করে এ দিন থেকে নতুন বছরের দিন শুরু করেন। বহু শতাব্দী প্রাচীন আগে শুরু হওয়া এই প্রথা এখনও পালিত হয়ে আসছে পুরুলিয়া জেলায়।
আগে ধানচাষের উপর নির্ভর করে মানুষজন বছরভর কী ভাবে থাকবেন, তার পরিকল্পনা করতেন। চাষের কিছুটা খাবার জন্য, কিছুটা চিকিৎসার জন্য, কিছুটা ছেলে-মেয়ের বিয়ের জন্য এবং সংসারের নানা কাজের ভাগ ভাগ করে জমিয়ে রাখতেন। তখন রাখাল-বাগাল থেকে খেত মজুর, ধোপা, নাপিতকেও ধান দেওয়ার চল ছিল। পৌষের শেষে মাঠ থেকে নতুন ধান উঠলে সেই ধানের কিছুটা বাগাল-খেত মজুর থেকে ধোপা-নাপিতকে নতুন বছরের প্রথম দিনেই দিয়ে তাঁর সঙ্গে বাৎসরিক চুক্তি করে রাখা হত। তাই এই দিনটির গুরুত্ব সমাজের সব মানুষের কাছেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এখন কৃষিকাজ ছাড়াও নানা পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছেন মানুষজন। কিন্তু কৃষিকে ভিত্তি করে কৃষিবর্ষ বা কৃষিঅব্দ পালনের রেওয়াজ এখনও আগের মতোই রয়েছে পুরুলিয়ার গ্রামে-গ্রামে। বুধবার, ১ মাঘ পুজো এবং নানা আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ বারও কৃষিবর্ষ পালিত হল। বহু এলাকায় গ্রাম দেবতার পুজো হয়। গ্রামের প্রান্তে চিঁড়ে, বাতাসা, কলা, নারকেল, ধূপ, সিন্দুর প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে পুজোপাঠ হয়েছে। কোথাও আবার গরাম থানে মোরগ বলি দেওয়া হয়েছে।
বোরো থানার মলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা সম্পন্ন চাষি হংসেশ্বর মাহাতো বলেন, “১ মাঘ জমিতে হাল দিয়ে কৃষিকাজের সূচনা করে রাখলাম।” আগামী বছর যাঁদের নানা কাজে প্রয়োজন, বছরের শুরুর দিনে অনেক গৃহস্থ তাঁদের সঙ্গে এ দিনই বছরভরের চুক্তি সেরে ফেলেন। আর তা করা হয়, ধান বিনিময়ের মাধ্যমে। যেমন হংসেশ্বরবাবু এ দিন বাগাল ও নাপিতকে ধান দিয়ে সারা বছরের চুক্তি সেরে ফেললেন। তাঁর কথায়, “বাপ-ঠাকুরদাদেরও দেখেছি ধান দিয়ে চুক্তি করতে। তাই আমিও করলাম। তবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় দু’জনকেই এ বার বেশি করে ধান দিতে হয়েছে।” বান্দোয়ানের বাসিন্দা জগদীশ মাহাতোর জমিতে ফি বছর ৫০০ মণ ধান ফলে। তাঁর মতে, “কৃষিবর্ষ নিয়ে এখনও মাতামাতি রয়েছে ঠিকই। ধান দিয়ে বাৎসরিক চুক্তি করার প্রচলন থাকলেও অনেকে টাকা খরচ করেও কাজ করান।”
মানভূম কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান তথা লোক গবেষক প্রদীপ মণ্ডলের কথায়, “জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করার সময় গ্রাম দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য কয়েক হাজার বছর আগে যে আরাধনার রেওয়াজ শুরু হয়েছিল, তা এখনও পালিত হয়ে আসছে। আগে হয়ত অন্য ভাবে কোনও নির্দিষ্ট দিন কৃষিবর্ষ শুরুর জন্য নির্ধারিত ছিল। পরবর্তীকালে মানুষজন নিজেদের সুবিধার জন্য দিনটি পরিবর্তিত করে ১ মাঘ ঠিক করে।” লোক গবেষক ক্ষীরোদ মাহাতো, সুভাষ রায়দের কথায়, “সাবেক মানভূম জেলা তথা পুরুলিয়া ও লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের বহু গ্রামে বাসিন্দাদের জীবন জল-জমি ও জঙ্গলকে ঘিরে আবর্তিত হয়। কৃষি-নির্ভর ওই মানুষদের কাছে কৃষিবর্ষের প্রথম দিনের গুরুত্ব তাই অনেক।” তাঁরা জানান, এই দিনটি অনেকে ‘আখ্যান দিন’ হিসাবে মানেন। কুড়মালি ভাষায় ‘আখ্যান’ শব্দের অর্থ জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। এই দিন থেকে সূর্য মকরক্রান্তি থেকে কর্কটক্রান্তির দিকে যাত্রা শুরু করে।
কৃষিবর্ষ বা কৃষিঅব্দ শব্দটি এই প্রজন্মের অনেকের কাছে অজানা থাকলেও লোকগবেষকরা বহমান এই প্রথাকে বিশ্লেষণ করে সেই জনজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। |