কলেজ ভোট দোরগোড়ায় আসতেই রাজ্যজুড়ে অশান্ত হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। বুধবার শিলিগুড়ি থেকে স্বরূপনগর, সর্বত্র নির্বাচনের আঁচ ছড়িয়ে পড়ল। অথচ ছাত্র ভোটে সংঘর্ষ অনেকটাই এড়ানো যেত, মনে করছে ছাত্রদের একাংশ। ছাত্র সংসদে নির্বাচনের পদ্ধতিতে অনলাইন প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে এ বছর। কিন্তু কার্যত তা ‘আধাখেঁচড়া’ ভাবে হয়েছে, বলে ক্ষোভ তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) বিরোধী একাধিক ছাত্র সংগঠনের। তাদের বক্তব্য, অনলাইনে মনোনয়ন তোলা যা-ও বা চালু হল, জমা নেওয়া চালু করা হল না। প্রার্থী নিজে মনোনয়ন জমা দিতে গেলেই তাঁর উপরে শাসক দলের হামলার সম্ভাবনা থাকছে। অনলাইন মনোনয়ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলে অনেক সমস্যা এড়ানো যেত।
এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাসের অভিযোগ, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চাইলেই অনলাইন মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে পারত। টিএমসিপি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা চায় না বলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তা করেনি।” ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “মনোনয়ন জমা দিতে সমস্যা হবে আঁচ করে অন্তত তিন মাস আগে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তা আর হল কই?”
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু অবশ্য ছাত্র-ভোটের মনোনয়ন নিয়ে অশান্তির সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিয়েছেন। “বিচ্ছিন্ন ভাবে কোথাও গণ্ডগোল হলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বা প্রশাসন তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস,” সোমবার বলেন তিনি। বুধবারই অবশ্য দেখা গেল, পুলিশ নামিয়েও ছাত্র সংঘর্ষ সামলানো কঠিন হয়ে উঠল প্রশাসনের কাছে।
মনোনয়নপত্র তোলা ও জমা দেওয়ার সময় বাধা দিয়ে একচেটিয়া ভাবে সংসদ দখল করার প্রবণতা বাম জমানায় ছিল এসএফআইয়ের। এখন টিএমসিপি-ও একই রোগের শিকার বলে নানা সময়ে অভিযোগ উঠছে। নানা জেলায় বেশ কিছু কলেজে বিপক্ষের মনোনয়ন জমা না-পড়ায় জিতে গিয়েছে টিএমসিপি। হাওড়ার ২০টি কলেজের কোনওটিতেই এসএফআই মনোনয়ন জমা দিতে পারেনি, ভোটের আগেই ১৯টি কলেজ এসেছে টিএমসিপি-র দখলে। হুগলির ৩২টি কলেজের ২৪টিতে মনোনয়ন জমা দিতে পারেনি এসএফআই, দক্ষিণ ২৪ পরগণার ২৬টি কলেজে ভোট হচ্ছে, কোনওটিতেই এখনও মনোনয়ন পত্র তুলতে পারেনি, বলছেন এসএফআই নেতারাই। পুরুলিয়ায় ১২টি কলেজে ভোট হয়ে গিয়েছে, ১১টিতে জিতেছে টিএমসিপি। ছ’টি কলেজে প্রার্থীই দিতে পারেনি এসএফআই।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে মনোনয়নপত্র তোলাকে কেন্দ্র করে হানাহানিতে প্রাণ হারান এক সাব-ইনস্পেক্টর। তার পরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন মাস ছয়েকের জন্য বন্ধ করে দেয় সরকার। সম্প্রতি সেই প্রক্রিয়া ফের শুরু হয়েছে। শান্তি রাখতে অনলাইনে মনোনয়নপত্র তোলা ও জমা দেওয়ার কোনও নির্দেশ রাজ্য সরকার থেকে আসেনি। যেখানে অনলাইনে ফর্ম তোলা হচ্ছে, সেখানে তা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে। তবে রাজ্যের সব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোনয়নপত্র তোলা ও জমা দেওয়ার কাজ অনলাইনে সারতে পারলে ছাত্রভোট যে অনেক নির্বিঘ্ন হত, শিক্ষা দফতরের কর্তারাও তা মানছেন।
রাজ্যে অনলাইনে মনোনয়নপত্র তোলা বা জমা দেওয়ার ছবিটা অবশ্য অসমান। অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া তো দূর, মনোনয়ন তোলার বিষয়টিই এখনও চালু করে উঠতে পারেনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র ভোট পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তা দেবকুমার পাঁজা বলেন, “মনোনয়ন অনলাইনে তোলা-জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধান বদলাতে হত। কলেজগুলির নিজস্ব নির্বাচন বিধিও পরিবর্তন করতে হত। অল্প সময়ে আমরা তা করে উঠতে পারিনি।” উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকারের আশ্বাস, আগামী বছর বিষয়টি দেখা হবে।
বিদ্যাসাগর বা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনলাইনে মনোনয়ন তোলার প্রক্রিয়া চালু করলেও, জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেননি। কেন? বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ বিভাগের প্রধান জয়ন্তকিশোর নন্দী বলেন, মনোনয়ন পত্র ওয়েবসাইটে দিয়ে দেওয়া অনেক সহজ। কিন্তু তা জমা নিতে গেলে একটা গোটা সফ্টওয়্যার তৈরি করতে হবে। যে ডাউনলোড করছে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া কি না, তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রাখতে হত সফটওয়্যারে। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সমীরকুমার দাস বলেছেন, “প্রতিটি কলেজে নির্বাচন পরিচালনার জন্য কমিটি রয়েছে। তারা চাইলে নিজ দায়িত্বে অনলাইন মনোনয়ন জমা নেওয়ার ব্যবস্থা চালু করতে পারে।” বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কলেজই প্রত্যন্ত এলাকায়। সেখানে সাইবার কাফে নেই।” ওই পড়ুয়াদের কী হবে, সেটাও ভাবতে হবে, বলছেন তিনি।
রয়েছে টাকার প্রশ্নও। কলেজে অনলাইনে ভর্তির ফর্ম তোলা বা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে ফর্মপিছু বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের একটা নির্দিষ্ট আয় হয়। কিন্তু নির্বাচনের জন্য অনলাইনে মনোনয়ন তোলা বা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে টাকা মিলবে না। মনোনয়ন-প্রক্রিয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে অর্থ চাওয়া হলে অধিকাংশ ছাত্র সংগঠন ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামবে বলে আগেই হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তাই মনোনয়ন তোলা থেকে জমা, পুরো প্রক্রিয়াটি অনলাইন করতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়, মনে করছেন নানা প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু আধিকারিক।
টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা অবশ্য বলেন, “এ বার তো তা-ও অনলাইনে মনোনয়ন পত্র তোলার ব্যবস্থা হয়েছে। আগে ছাত্র-ভোট পর্বে এসএফআই কী অত্যাচার করত, তা কেউ ভোলেননি।”
|