|
|
|
|
|
|
সঞ্চয়ের পরামর্শ |
নিজেই আলো জ্বালুন
পায়ের নীচের জমি আলগা। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন— কিচ্ছু নেই।
তবে এর মধ্যেও চেষ্টা করলে, একটু একটু করে জমিয়ে এই সব খাতে সঞ্চয়ের
ব্যবস্থা করে নিতে পারেন আপনি নিজেই।
লিখছেন অমিতাভ গুহ সরকার |
|
এক সমুদ্র মানুষ, যাঁদের বয়সকালে কাজ আছে। উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন। সমাজে বহুবিধ পরিষেবা দেন। কিন্তু বয়স ফুরোলে কিছু নেই। সমাজ বহু সেবা নেয় এঁদের কাছ থেকে। অথচ এঁদেরই কোনও সামাজিক সুরক্ষা নেই। পেনশন, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড— কিচ্ছু না। বিমার জগতেও তাঁদের বড় একটা দেখা যায় না। এই সব মানুষেরও কিন্তু একটি পরিবার থাকে। থাকে সন্তানের শিক্ষা, পরিবারে অসুখ-বিসুখ। থাকে কাজের বয়স পেরিয়ে গেলে ভবিষ্যতে কী করে জীবন চলবে, তার ভাবনাও। তবে প্রায় সবটাই অন্ধকারে মোড়া।
|
আলোর হদিস |
হকার, দোকানকর্মী, রিক্সাচালক, ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, আয়া, গৃহ-পরিচারক/পরিচারিকা, ছোট বিনিয়োগ এবং বিমা এজেন্ট, মিস্ত্রি, দিনমজুর, ১০০ দিনের কাজের মানুষ, মাছ এবং সব্জি বিক্রেতা, ছোট ব্যবসায়ী, আবাসনের নিরাপত্তা রক্ষী— অসংগঠিত ক্ষেত্রের এ রকম বিভিন্ন পেশার মানুষের সংখ্যাটা বিশাল। একসঙ্গে করলে হয়তো বহু দেশের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে। সরকার নির্বাচনে তাঁদের বড় ভূমিকা থাকলেও, নির্বাচিত সরকারের মাথাব্যথা থাকে না তাঁদের নিয়ে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে নিজেদের জন্য আন্দোলনের ফুরসতও পান না এই জনতা। তাই তাঁদের জন্য বড় আন্দোলন হয় না। শেখানো হয় না, কোন পথে নিজেরাই নিজেদের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেন। আজ আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করব এটাই। তাঁরা কোন পথে তিল তিল করে নিজেরাই নিজেদের পিএফ, গ্র্যাচুইটি, পেনশনের ব্যবস্থা করতে পারেন। সঞ্চয় গড়ে তুলে বাঁচতে পারেন আলোয়।
|
প্রভিডেন্ট ফান্ড |
ডাকঘর বা কোনও ব্যাঙ্কে পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকাউন্ট খুলুন। ১৫ বছর মেয়াদি এই অ্যাকাউন্টে প্রতি বছর টাকা জমান সাধ্যমতো। প্রথম ১৫ বছর পর ৫ বছর করে মেয়াদ বাড়িয়ে যান। কর্মজীবনে এই অ্যাকাউন্ট থেকে কোনও টাকা তোলা চলবে না। দীর্ঘ মেয়াদে করমুক্ত সুদ-আসল গড়ে দেবে বড় তহবিল, যা কর্মজীবনের শেষে প্রভিডেন্ট ফান্ডের জায়গা নিতে পারে। এই অ্যাকাউন্টে বছরে ন্যূনতম জমা মাত্র ৫০০ টাকা, সর্বাধিক ১ লক্ষ।
|
গ্র্যাচুইটি |
|
একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলুন। ব্যবসা বা অন্য সূত্র থেকে যখনই একটু বেশি টাকা হাতে আসবে, তা জমা করুন এই অ্যাকাউন্টে। কিছু টাকা জমে উঠলে সেটা দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে জমা করে দিন। এই ভাবে সুদে-মূলে অনেক লম্বা মেয়াদে গড়ে উঠবে গ্র্যাচুইটি তহবিল।
চাইলে আপনি থোক টাকা রাখতে পারেন সদ্য বাজারে আসা ইনফ্লেশন ইনডেক্সড বন্ড-এ। এটি হল এক ধরনের ঋণপত্র, যাতে টাকা রাখলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকে বেশি সুদ পাওয়া যাবে। ফলে আপনার জমানো টাকা বেড়ে যা দাঁড়াবে, তার পুরোটা মূল্যবৃদ্ধি খেয়ে ফেলতে পারবে না।
|
পেনশন |
যত অল্পই হোক, টাকা জমান নিয়মিত। লক্ষ্য হবে দীর্ঘ মেয়াদে বড় তহবিল গড়ে তোলা, যা উপযুক্ত প্রকল্পে রেখে অবসরের পর নিয়মিত আয় পাবেন।
অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন সরকারের নিউ পেনশন প্রকল্পে। যাঁদের আয় খুব সামান্য, তাঁরা প্রত্যেক দিনের আয় থেকে অন্তত ১০ টাকা তুলে রাখুন। এই ভাবে মাসে অন্তত ৩০০ টাকা জমালে, বছরে হবে ৩৬০০ টাকা। কর্মজীবনের মেয়াদ যদি গড়ে ৪০ বছর ধরা হয়, তবে জমানো মূল টাকার অঙ্ক হবে ১,৪৪,০০০ টাকা। গড়ে ৮.৫ শতাংশ ক্রমপুঞ্জিত সুদ সহকারে এই সঞ্চয় ফুলেফেঁপে হতে পারে ১২,১১,৫৯৬ টাকা। দিনে যদি ১৫ টাকা করে জমানো যায়, তবে ৪০ বছরে তা সুদে আসলে হবে ১৮,১৭,৩৯৪ টাকা। এই তহবিল উপযুক্ত সুরক্ষিত প্রকল্পে লগ্নি করে আজীবন পেতে পারেন মাসিক পেনশন।
ব্যাঙ্কে রেকারিং ডিপোজিট (আরডি) অ্যাকাউন্ট খুলেও নিয়মিত টাকা জমানো যায়। মেয়াদ শেষে জমা টাকা ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে রেখে নতুন আরডি অ্যাকাউন্ট খোলা যেতে পারে। দোকান এবং ছোট সংস্থার মালিকেরা তাঁদের কর্মীদের প্রতি দায় মেটাতে খুলে দিতে পারেন আরডি অ্যাকাউন্ট ও নিয়মিত জমা করার কথা ভাবতে পারেন উপযুক্ত একটি অঙ্ক। শুধু দায় মেটানো নয়, এই পথে ভালবাসা, আনুগত্যও অর্জন করা যায়।
|
বিমা |
আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য বিমা খুব জরুরি। এঁদের জীবনে ঝুঁকি বেশি। তাই জীবনবিমা ও স্বাস্থ্য বিমা, দু’টিই দরকার। খুব ছোট অঙ্কের হলেও সাধ্যমতো বিমা করা উচিত প্রত্যেকেরই। এ ব্যাপারে মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে বিমা সংস্থাগুলিকেও। নামমাত্র প্রিমিয়ামে জনতা পলিসির বড় প্রয়োজন এ দেশে। ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, অটোচালক, নির্মাণ -কর্মী ইত্যাদি মানুষ, যাঁদের জীবনের ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি, তাঁদের জন্য কম খরচে থাকা উচিত দুর্ঘটনা বিমার সুবিধা। কিছু ব্যাঙ্কে সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুললে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে দুর্ঘটনা বিমার সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সরকারও উদ্যোগী হচ্ছে এই ব্যাপারে।
গ্রামের মানুষেরা গ্রামীণ ডাক জীবনবিমা (রুরাল পোস্টাল লাইফ ইনশিওরেন্স) করার সুবিধাও নিতে পারেন। এখানেও প্রিমিয়াম সামান্যই।
|
টাকা জমানোর নিয়ম |
• জমাতে হবে নিয়মিত। কোনও ছেদ পড়লে চলবে না। পরিমাণ যত ছোটই হোক, জমান দীর্ঘ মেয়াদে। তা হলে আসলের তুলনায় সুদ অনেক বেশি হবে।
• জমা টাকা খরচ করা চলবে না। তা রেখে দিতে হবে অবসর জীবনের জন্য।
• ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট না-থাকলে, অবিলম্বে খুলুন। বাড়িতে টাকা জমালে সুদ পাবেন না। তা খরচ হয়েও যেতে পারে। আবার চুরিও হতে পারে। অনেকেরই হয়তো কে ওয়াই সি সংক্রান্ত কাগজের সমস্যা আছে। যে কোনও ভাবে এই সমস্যা মিটিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলুন।
• চিট ফান্ডের আকাশছোঁয়া সুদের লোভে পা দেবেন না। লগ্নি করুন একশো শতাংশ সুরক্ষিত জায়গায়।
• যত বড় লাভেরই প্রলোভন থাকুক, ছোট, অজানা শেয়ারে লগ্নি করবেন না।
• সঞ্চয়ের উপর মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ঠেকাতে টাকা রাখুন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইনফ্লেশন ইনডেক্সড বন্ডে।
• নিজের জ্ঞান কম থাকলে, সঞ্চয়ের ব্যাপারে সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষের সাহায্য নিন। প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা যদি একটু সময় ব্যয় করে আশপাশের আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষকে সঞ্চয় ও লগ্নির ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তবে সমাজের বড় উপকার হয়। এটি অবশ্যই এক ধরনের সমাজসেবা।
• অবসরের জন্য জমানো টাকা ব্যবসায়ে লাগাবেন না। মনে হতে পারে ব্যাঙ্ক সুদের তুলনায় ব্যবসায়ে লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, ব্যবসার দুর্দিনে পুরো টাকাটাই ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ব্যক্তিগত তহবিলকে ব্যবসার তহবিল থেকে আলাদা করেই রাখতে হবে।
• যে-কোনও উপায়ে অতি চড়া সুদে ঋণ নেওয়া এড়িয়ে চলতে হবে।
• আর্থিক সাক্ষরতা বাড়ানোর চেষ্টা করুন। মাথায় রাখুন কর্মজীবনের পরের দিনগুলির কথা। বাজে খরচ বন্ধ করুন। |
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|