বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এই সময়টা খয়রাশোলের মুক্তিনগর গ্রামটি কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। সকাল-বিকেল রাস্তার মোড়ে বা গুটিকয় চা, তেলেভাজার দোকানে তেমন লোকজনের দেখা মেলে না। দেখা মিলবেই বা কী করে। গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দাই যে এখন বাইরে। তাঁরা খেজুর গুড়ের কারিগর।
আশ্বিন মাসে গ্রাম, ব্লক, জেলা ছাড়িয়ে এমনকী রাজ্য ছাড়িয়ে ওঁরা পাড়ি দেন ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। উদ্দেশ্য একসঙ্গে প্রচুর খেজুরগাছ খুঁজে সেখানেই অস্থায়ী আস্তানা তৈরি করে গুড়ের ব্যবসা করা। আর সেই কারণেই ওই গ্রামের অনেক বাড়িতে তালা ঝুলছে। আবার কেউ কেউ একজন বা দুজন বয়স্ক মানুষ বা ছোট ছেলেমেয়েদের ভরসায় ঘর ছেড়েছেন। কারণ, আশ্বিন থেকে মাঘ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খয়রাশোলের ওই গ্রামের বাসিন্দাদের অধিকাংশই খেজুর গুড় তৈরি করতে বাইরে চলে যান।
খয়রাশোলের হিংলো ও অজয় মধ্যবর্তী এলাকায় বহু বছর আগে থেকে বসবাস করছেন বাংলাদেশ থেকে আসা বেশ কিছু উদ্বাস্তু পরিবার। বর্তমানে বসবাসকারি পরিবারের সংখ্যা ২২০। অনেক দিন আগে থেকে ভোটার কার্ড থাকলেও, কয়েক বছর আগেও অধিকাংশ বাসিন্দার রেশন কার্ড ছিল না। ছিল না রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ। বর্তমানে অবশ্য সেই ছবিটা বদলেছে। কিন্তু এ সব হওয়ার আগে শুধুমাত্র কায়িক পরিশ্রমে দু’টি নদীর মধ্যবর্তী জমিতে সোনার ফসল ফলিয়েছেন ওই গ্রামের বাসিন্দারা। এখনও সেই ধারা বজায় রয়েছে। তবে শীত আসার সময় হলেই অধিকাংশ গ্রামবাসী খেজুর গুড় তৈরির জন্য বীরভূমের অন্য গ্রামে যাওয়ার পাশাপাশি অজয় পেরিয়ে বর্ধমানের পান্ডবেশ্বর, হরিপুর, আসানসোল, দোমানী, বার্ণপুর এমনকী ঝাড়খণ্ডেও পৌঁছে যান। |
এ বার অন্তত ১২০-১৫০টি পরিবারের লোকজন বাইরে গিয়েছেন। শুধু ওই গ্রামের লোকজনই নন, গুড় তৈরিতে দক্ষ বাইরের জেলার লোকেদেরও ভাড়া করা হয়। যাঁদের অবস্থা স্বচ্ছল, তাঁরা একসঙ্গে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারেন। তাঁরা ১৫০-২০০টি খেজুর গাছ কাটার (রস সংগ্রহ) চুক্তি করেন। আর যাঁরা অত টাকা খরচ করতে পারেন না, তাঁরা গ্রামের যে পরিবার ‘মহল’ তৈরি করছেন তাঁদের হয়ে খাটতে যান। যে সব পরিবার নিজেরাই ‘মহল’ করছেন শীত ও বাজার ঠিকমতো থাকলে মরসুম শেষে ৪০-৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন।
বছরের কয়েক মাসের জন্য রুজির টানে ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুও হয় কারও কারও। কেউ বা সদ্যোজাতকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আবার এমনও পরিবার রয়েছে যেখানে দু’একটি শিশু বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধার উপরেই এই ক’মাস সংসারের দায়িত্ব থাকে। ষষ্ঠ শ্রেণির মেঘনা সূত্রধর, সপ্তম শ্রেণির বিথীকা চক্রবর্তী, সুপ্রিয়া অধিকারি বা পঞ্চম শ্রেণির উজ্জ্বল অধিকারিদের রান্না করে তারপর স্কুলে যেতে হয়। পড়শি বা আত্মীয় যাঁরা কাছাকাছি থাকেন তাঁরাই মূলত ওদের দেখাশোনা করেন। তাদের কথায়, “সবই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। খুব একটা অসুবিধা হয় না। তা ছাড়া, সপ্তাহে একবার করে মা-বাবা ঘরে আসেন।”
এ বার গুড় তৈরি করতে বর্ধমানের গাইঘাটায় গিয়েছেন মেঘনার বাবা-মা রবীন্দ্র ও বিশাখা সূত্রধররা। আর দীপিকার বাবা-মা অবিনাশ ও অনিমা চক্রবর্তীরা গিয়েছেন বার্ণপুর নিউটাউনের কাছে নাগড়াসাটায়। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উভয়েই বলেন, “ছোট ছেলেমেয়েদের ছেড়ে বাইরে পড়ে থাকতে ভাল লাগে না। কিন্তু চাষ ছাড়াও গুড় তৈরি করে যেটুকু রোজগার হয় সেটাতেই বাড়ির অন্যান্য খরচ, ছেয়েমেয়েদের পড়াশোনার এবং ঘর তৈরি বা সারানের খরচ চলে। তাই এ কাজ না করে উপায় নেই।”
সবাই যে বাইরে গিয়েছেন এমনটা কিন্তু নয়। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে বেশ কিছু খেজুর গাছ চুক্তিতে নিয়ে মহল করছেন চিত্ত বিশ্বাস ও তাঁর ছোট ছেলে বিকাশ। আবার গ্রামের একজনের হয়ে পাণ্ডবেশ্বরে মহলে খাটতে গিয়েছেন প্রদীপ ব্যাপারী। বছর তিনেকের ছেলে শুভঙ্করকে কোলে প্রদীপবাবুর স্ত্রী অষ্টমী ব্যাপারী বলেন, “ভাদ্র মাস ঢুকলেই কোথায় প্রচুর খেজুর গাছ আছে, তার সন্ধান চালাতে হয়। কারণ, গাছের মালিকের সঙ্গে চুক্তি সেরে ফলতে হবে। এ বার চার মাসের জন্য ৩২ হাজার টাকা পাওয়া যাবে। দূরে থাকলেও টাকাটা তো কম নয়। তা ছাড়া সুযোগ পেলেই একবার করে ঘরে আসেন সকলেই।” |