বেশি লাভের আশায় ধান, সব্জির চিরাচরিত চাষ ছেড়ে অনেকেই ঝুঁকেছিলেন ফুল চাষে। শুরুর দিকে লাভও হত। কিন্তু ঠিক মতো প্রশিক্ষণ বা আধুনিক যন্ত্রাংশের অভাবে বর্তমানে নানা সমস্যায় ভুগছেন ফুলচাষিরা। তাঁদের দাবি, সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকা মুশকিল।
প্রতি বছর শীতের আগেই পূর্বস্থলী ২ ব্লকের পলাশফুলি গ্রামের বেশ কয়েকজন চাষি শীতকালীন ফুলের চারা তৈরি করেন। পুজোর মাসখানেক আগে থেকেই কাজ শুরু হয়ে যায়। ওই চাষিদের দাবি, তাঁদের দেখে নবপল্লি, পারুলিয়া, লক্ষ্মীপুর, পাটুলি, বেলের হাট-সহ বেশ কিছু এলাকাতেও ফুলের চারা তৈরির বিকল্প চাষ শুরু হয়। অনেকে আবার আম, কাঁঠাল, লেবু, পেয়ারা বা আমলকির মতো ফলের চারা তৈরিতেও উৎসাহ দেখান। চাষিদের দাবি, বর্তমানে পাঁচ হাজারেরও বেশি জমিতে বিকল্প চাষ হিসেবে ফুল, ফলের চারা তৈরি হয়। |
শুধু চাষিরাই নন, এই ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছেন আরও হাজার হাজার মানুষ। মরসুম শুরু হতেই যাঁরা ভিড় করে পাইকারি দামে চাষিদের কাছ থেকে গোলাপ, গাঁদা, গ্ল্যাডিওলাস, ক্যালেন্ডুলা, কসমস, বেবিডল-সহ পঞ্চাশেরও বেশি চারা কেনেন। তারপরে কাগজে মুড়ে কখনও ঝুড়িতে করে গ্রামে গ্রামে, আবার কখনও গাড়িতে করে তা পৌঁছে যায় রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে। সম্প্রতি বিধানচন্দ্র কৃষি বিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক পূর্বস্থলীতে কৃষি সংক্রান্ত এক আলোচনা শিবিরে যোগ দেন। সেখানেই ফুল চাষিরাও তাঁদের নানা সমস্যার কথা জানান। চাষিদের দাবি, শুরুর দিকে এলাকায় উৎপাদনের সঙ্গে চাহিদার সামঞ্জস্য থাকায় সমস্যা ছিল না। কিন্তু এখন অনেকেই এই চাষে আসায় বাজার মিলছে না। ভিন জেলার চাহিদার ক্ষেত্রেই মূলত নির্ভর করতে হচ্ছে। এছাড়া প্রশিক্ষণ না থাকায় আধুনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে চারার মান বাড়াতেও সেভাবে পারছেন না তাঁরা। তাঁদের অভিযোগ, জেলা উদ্যান পালন দফতরে বিষয়টি নিয়ে বারবার জানিয়েও লাভ হয়নি।
পূর্বস্থলী নার্সারি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিখিল শীল বলেন, “আমরা রাসায়নিক সার ব্যবহার করি। অথচ বাইরের ক্রেতারা জৈব পদ্ধতি মেনে তৈরি করা চারা খোঁজেন। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা না থাকায় পিছিয়ে পড়ছি আমরা।” তাঁর দাবি, এলাকার চাষিরা আধুনিক প্রশিক্ষণ ও সরকারের উদ্যোগে কিছু যন্ত্র পেলে বিকল্প চাষ হিসেবে চারা তৈরি আরও বাড়বে। চাষিরা জানান, চাষের সময় ঝড়, শিলাবৃষ্টি হলে জমিতেই নষ্ট হয়ে যায় বহু চারাগাছ। এ ক্ষেত্রেও সরকারি সাহায্যও মেলে না বলে অভিযোগ তাঁদের। এমনই এক চাষি রমেন শীল বলেন, “এ বছর পুজোর আগে ও পরে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। অনেক গাছও পচে গিয়েছে। তারপর নতুন করে জমি বানিয়ে চারা তৈরি করতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। অথচ শীতের কামড় চলে গেলে, চারার কদর থাকে না।” তাঁর আশঙ্কা, “এ বার অনেক চারা জমিতেই পড়ে থাকবে।” রমেনবাবুর দাবি, নদিয়া ও উত্তর চব্বিশ পরগণার বহু চাষি গাঁদার মতো ফুল চাষ করে সারা বছর ভাল আয় করেন। কিন্তু ওই এলাকায় ফুল চাষের ব্যাপারে সরকারি ভাবে চাষিদের উৎসাহ দেওয়া হয় না বলে তাঁর অভিযোগ।
নার্সারি ব্যবসায়ী সমিতির কোষাধ্যক্ষ গৌতম ভট্টাচার্য জানান, অনেক চাষিই রোগ, পোকা সম্বন্ধে জানেন না। অথচ চারা তৈরি করার সময় চাষিদের তার মুখোমুখি হতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু না বুঝে জমিতে কীটনাশক স্প্রে করেন তাঁরা। এতে আর্থিক ভাবে তাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ বিষয়ে সচেতন হলে খুব সহজেই সমস্যা এড়ানো যায় বলেও গৌতমবাবুর দাবি।
চাষিদের সমস্যার কথা শুনে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তপন মাইতি বলেন, “আপনারা চাইলে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ফুল চাষের বিশেষজ্ঞকে এই এলাকায় আনা যেতে পারে। তাঁরা এ ব্যাপারে পরামর্শ দেবেন।” এছাড়া নার্সারিতে ফুল, ফলের চারা তৈরি ছাড়াও বর্ষাকালীন পেঁয়াজের চারা তৈরি করার পরামর্শ দেন তপনবাবু।
চাষিদের নানা সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর আশ্বাস, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। |