কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, গাইঘাটার নারী-নিগ্রহের মতো ঘটনা ঠেকাতে রাজ্য পুলিশে এডিজি স্তরে আরও একটি নতুন পদ সৃষ্টি করছে সরকার। গোটা দক্ষিণবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে ওই অফিসারকে। সোমবার পুলিশ এস্টাব্লিশমেন্ট বোর্ড (এসপি ও তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বদলির সুপারিশ করে)-এর জরুরি বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নবান্ন সূত্রের খবর, এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) নামে ওই নতুন পদের জন্য সি ভি মুরলীধরের নাম সুপারিশ করেছে বোর্ড। এখন তিনি কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্সের এডিজি। আজ, বুধবার ওই সুপারিশ অনুমোদন করার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। রাজ্যে ক্রমবর্ধমান নারী-নিগ্রহ, বিশেষত উত্তর ২৪ পরগনায় পরের পর ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) পদ তৈরি করা হচ্ছে বলে প্রশাসনের একাংশের অভিমত। নবান্নের এক কর্তা বলেন, “এডিজি (উত্তরবঙ্গ) নামেও একটি নতুন পদ তৈরির কথা স্বরাষ্ট্র দফতরের বিবেচনায় রয়েছে।”
প্রাথমিক ভাবে উত্তর ২৪ পরগনার পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ)-র মূল কাজ বলে নবান্নের ওই কর্তা জানান। অন্যান্য জেলার দিকেও নজর দেবেন তিনি। এখন দক্ষিণবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা দেখভাল করেন আইজি পদমর্যাদার দুই অফিসার। আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) দেখেন দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ এবং হুগলি, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও দুই মেদিনীপুর দেখার দায়িত্ব আইজি (পশ্চিমাঞ্চল)-র। ওই নবান্ন-কর্তার বক্তব্য, এতে অনেক সময় সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। দুই আইজি-র মাথায় এক জন এডিজি থাকলে গোটা দক্ষিণবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা তুলনায় সহজ হবে।
কিন্তু পুলিশে পদস্থ কর্তার সংখ্যা বাড়ালেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে রাজ্য প্রশাসনের অন্য একটি অংশের। তাঁদের বক্তব্য, বাহিনীকে এক অফিসারের নির্দেশে (সিঙ্গল কম্যান্ড) রাখা যে যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু যাঁদের দিয়ে তিনি কাজ করাবেন, সেই নিচু তলার পুলিশের সংখ্যা দিন দিন এতই কমছে যে, থানাগুলি অসহায়। উত্তর ২৪ পরগনাও সেই সমস্যায় জেরবার। ওই জেলার এক পুলিশকর্তা বলেন, “তদন্ত বা অপরাধী ধরা পুলিশের মূল কাজটা করেন সাব ইনস্পেক্টরেরা (এসআই)। তাঁরাই কার্যত থানা চালান। কিন্তু এই জেলায় যেখানে ৪০০ এসআই থাকার কথা, সেখানে আছেন মাত্র ১৭৫ জন। মহিলা এসআইয়ের সংখ্যা আরও কম গোটা জেলায় মাত্র তিন জন।”
একেই থানাগুলিতে লোকাভাব। যাঁরা আছেন, তাঁদের দিয়েও যে সন্তোষজনক কাজ মিলছে না, তা মেনে নিচ্ছেন ওই জেলার পুলিশকর্তাদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, বছর দুয়েক আগে উত্তর ২৪ পরগনা ভেঙে ব্যারাকপুর ও বিধাননগর কমিশনারেট তৈরির ফলে সেখানকার আইনশৃঙ্খলার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তাতে সমস্যা হচ্ছে জেলার বাকি অংশের। কেন?
ওই পুলিশকর্তা জানান, জোড়া কমিশনারেট তৈরির সময়ে জেলার দক্ষ পুলিশ অফিসারদের অনেকেই সেখানে চলে যান। যাঁরা জেলা পুলিশে থেকে যান, তাঁদের একটা বড় অংশের বয়স হয়েছে, অনেকে কাজেও তেমন দড় নন। ফলে নিত্যদিনের আইনশৃঙ্খলা সামাল দেওয়াই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা অবশ্য উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশের এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন। তাঁরা বলছেন, বহু দিন পুলিশে নিয়োগ বন্ধ থাকায় প্রায় সব জেলারই কমবেশি একই অবস্থা। তা হলে কেন শুধু উত্তর ২৪ পরগনা নারী-নিগ্রহে বারবার শিরোনামে আসছে? কেনই বা একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা সত্ত্বেও ওই জেলার পুলিশ আশানুরূপ সক্রিয় নয় প্রশ্ন ওই স্বরাষ্ট্র-কর্তাদের। তবে নিচু তলায় পুলিশের সংখ্যা কমে যাওয়াটা যে অপরাধ ঠেকানোর পথে বড় অন্তরায়, সেটা মানছেন তাঁরা।
এই অবস্থায় কী করণীয়?
রাজ্য প্রশাসনের ওই কর্তাদের বক্তব্য, পুলিশকেই নিজের কাজ যথার্থ ভাবে করতে হবে। উত্তর ২৪ পরগনা পুলিশ নারী-নির্যাতন রোধে জেলা জুড়ে ফ্লেক্স-ব্যানার টাঙানো, মেয়েদের স্কুলে নিয়মিত সভা কিংবা মহিলাদের নিয়ে পাড়া কমিটি তৈরির যে-সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো সহায়ক পদক্ষেপ। এতে সাময়িক কিছু কাজ হলেও সুদূরপ্রসারী ফল পেতে খোলনলচে বদলাতে হবে পুলিশি পরিকাঠামোর ।
এত কম পুলিশ নিয়ে যে সেটা সম্ভব নয়, তা মানছেন প্রশাসনের ওই কর্তারা। কারণ, শুধু যে উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশই লোকাভাবে ভুগছে, তা নয়। গোটা রাজ্যের ছবিটা প্রায় একই। এই মুহূর্তে রাজ্য পুলিশে ২০০০টি এসআই-পদ খালি। মহিলা এসআইয়ের পদের সংখ্যা ৩৫৮, আছেন ৯৮ জন। একাধিক পুলিশকর্তার বক্তব্য, অপরাধ দমনের দায়িত্ব যাঁদের, সেই নিচু তলার পুলিশের সংখ্যা যে-ভাবে কমে যাচ্ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। শুধু সিভিক পুলিশের পিছনে টাকা ঢেলে এই সমস্যার সমাধান হবে না, বলছেন পুলিশকর্তারা।
|