রবীন্দ্র সরোবর এলাকার আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ দুলাল বৈদ্য কিংবা কর্নাটকের শিবা মাদুরের এগারো মাসের মেয়ে চন্দা, মধ্যপ্রদেশের কিশোরী পার্বতী কিংবা সুরাতের প্রতিবন্ধী যুবক প্রকাশ শাহ কত কারণে গঙ্গাসাগরে কত মানুষের আসা-যাওয়া। মকর সংক্রান্তির ভোরে সে সবের সাক্ষী থাকল পুণ্যসলিলা গঙ্গার স্রোত।
বাবা-মায়ের মনোস্কামনা পূরণেই ঠান্ডা জলে গা ভেজাতে হল ছোট্ট চন্দাকে। শরীরটা কুঁকড়ে একসা। কান্নার চোট থামায় কার সাধ্য। কিন্তু ধর্মপ্রাণ শিবা মন শক্ত করে মেয়েকে জলে চোবালেন। ভাঙা হিন্দিতে বলেন, “মানত আছে। কাঁদলে চলবে?” |
এ যদি হয় ভক্তিমার্গের নমুনা, দুলালবাবু আবার কর্মযোগের পরাকাষ্ঠা। সাগর মেলার শুরুতেই ২৮ জন সাঁতারুর দল নিয়ে চলে এসেছেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত তাঁদের একটাই কাজ। বাঁশি বাজিয়ে চেঁচাচ্ছেন জলের ধারে দাঁড়িয়ে, ‘‘পানিমে দূর মৎ যাও। খাতরা হ্যায়।’’ কলকাত্তাইয়া হিন্দিতেও বৃদ্ধের দাপট চোখে পড়ার মতো।
পার্বতীর আবার বিয়ে-থা নিয়ে খানিক দুশ্চিন্তায় আছে। সাগরের জলে তার সব ফাঁড়া কাটবে, এই বিশ্বাসে হি হি করতে করতে ডুব দিল জলে। শরীর-স্বাস্থ্য চাঙ্গা হবে, প্রকাশের একটাই ইচ্ছে।
মঙ্গলবার ভোরের আলো ফোটার আগেই পাঁজি-পুঁথি দেখে জলে নেমে পড়েছিলেন পুণ্যার্থীরা। অনেকে আবার সকালে ভাটার জলে স্নান করতে নারাজ। পুণ্যলাভের সঙ্গে বড় বড় ঢেউয়ের হাল্কা অ্যাডভেঞ্চারও চান কেউ কেউ। রাত থাকতেই জলে নেমে পড়েছিলেন তাঁরা। কয়েক জন পুলিশকর্মীকেও দেখা গেল সাগর তটে উর্দি খুলে জলে ঝাঁপালেন। জল থেকে উঠতে উঠতে তাঁদেরই এক জন বললেন, “সারা দিন চোর-ডাকাতের পিছনে ঘুরে সময় কাটে। তীর্থ স্থানে ডিউটি তো রোজ রোজ পড়ে না। কাজের ফাঁকে একটু পুণ্য কি আমরাও পেতে পারি না?” ধর্মনিষ্ঠ প্রবীন পুলিশ কর্মীকে কে বোঝাবে, যেখানে যার কাজ, সেখানেই তার মুক্তি। সাংবাদিক সম্মেলনে বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত বলেন, “তীর্থে এসে হিন্দু পুণ্য করবে না, তা-ও কি হয়। তাই সাগরে তো একবার গা ভেজাতেই হবে।” মেলার নোডাল অফিসার তথা রাজ্যের পঞ্চায়েত ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও হেসে বললেন, “মাথায়, গায়ে জল ছিটিয়ে নিয়েছি।”
সোমবারই হাওয়া অফিস আভাস দিয়েছিল, পৌষ সংক্রান্তির দিন শীত কিছুটা হলেও কামড় বসাবে। এমনিতে সাগরে আসা লোকজন সে সবের থোড়াই কেয়ার করেন। তবে এ বার ঠান্ডা কিন্তু কমই ছিল, জানাচ্ছেন পুণ্যার্থীরা। তাপমাত্রা ছিল ১৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে ১ ডিগ্রি কম। সাগরে ডুব দিয়ে উঠে হরিদ্বারের সাধু ভূদেব স্বামী ভারি গলায় বলে উঠলেন, “ঠন্ড কঁহা হ্যায় বেটা। সব উপরওয়ালেকা খেল।”
পুণ্যার্থীদের পরিকাঠামোগত সব রকম সাহায্যের আশ্বাস ছিল প্রশাসনের তরফে। যদিও স্নান সেরে ফেরার পথে অনেককেই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সকাল সকাল যাঁরা কচুবেড়িয়া ও চেমাগুড়ি, বেনুবন ফিরছিলেন, দুপুরে দিকে তাঁদের বাস ফুলডুবি, হরিণবাড়ি এলাকায় মাঝপথেই আটকে যায়। পাশাপাশি অভিযোগ ওঠে, ওই সব জায়গায় খাবার জল পর্যন্ত মেলেনি। আবার চেমাগুড়ি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে প্রিপেড ট্যাক্সি বুথে কোনও কর্মীর দেখা না পাওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন কেউ কেউ। গোটা চারেক ব্যাগ ঘিরে বোমাতঙ্কও ছড়ায় বলে জানালেন পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী। বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড অবশ্য খানিক ধূলিধূসরিত জামা-কাপড় ছাড়া সে সব ব্যাগ থেকেই কিছুই পায়নি।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, এ দিন প্রায় সাড়ে ৯ লক্ষ লোকের সমাগম হয়েছিল। সকলের চাওয়া-পাওয়ার সাক্ষী থাকল মকর সংক্রান্তির সাগর। |