মহিলাদের উপরে নির্যাতন রুখতে এক দিকে মধ্যমগ্রাম, বারাসত-সহ গোটা উত্তর ২৪ পরগনায় বিভিন্ন ব্যবস্থা নিচ্ছে রাজ্য সরকার। তারই মধ্যে ফের দু’-দু’টি নারী-নিগ্রহের ঘটনা ঘটল ওই জেলায়। জেলা পুলিশ জানিয়েছে, বসিরহাটে এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে। জেলা সদর বারাসতেও এক ছাত্রীকে মদ খাইয়ে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ এসেছে। নির্যাতিতা মেয়ে দু’টিকে বারাসত ও বসিরহাট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
বসিরহাটের মেয়েটির বয়স প্রায় ১৮ বছর। ছোটবেলায় পোলিও হওয়ায় তার পা দু’টি সরু কাঠির মতো। ঘরে কোনও মতে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পড়শিরা জানান, ভাল করে কথাও বলতে পারে না সে। ঘরে ঢুকে ওই প্রতিবন্ধীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ১১ জানুয়ারি ঘটনাটি ঘটলেও প্রথমে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়। এলাকার লোকজনকে নিয়ে সালিশি সভার পরে মঙ্গলবার বিকেলে বসিরহাট থানায় অভিযোগ দায়ের করেন মেয়েটির বাবা। অভিযুক্তকে ধরতে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। মেয়েটির ডাক্তারি পরীক্ষা হচ্ছে।
পুলিশি সূত্রের খবর, বসিরহাট থানার পিঁফা এলাকায় প্রতিবন্ধী মেয়েটির বাবার চায়ের দোকান। তাঁর বাড়িতে রাজমিস্ত্রির সঙ্গে জোগাড়ের কাজ করতে এসেছিল মুজিবর সর্দার নামে বসিরহাটের কঠুর গ্রামের এক যুবক। ১১ জানুয়ারি মেদিনীপুরে একটি ধর্মসভায় যোগ দিতে যান ওই দোকানি। দোকান সামলাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী। বাড়ির একটি ঘরে ওই প্রতিবন্ধী কিশোরী এবং অন্য ঘরে তার বৃদ্ধা ঠাকুরমা ছিলেন। মেয়েটির পরিবারের অভিযোগ, ওই দিন রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ মুজিবর মেয়েটির ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তাকে ধর্ষণ করে। মেয়েটির গোঙানির আওয়াজ পেয়ে ঠাকুরমার সন্দেহ হয়। ঠাকুরমা জানান, ধাক্কা মেরে দরজা খুলে তিনি মুজিবরকে দেখতে পান। তাঁকে ধাক্কা মেরে মুজিবর পালিয়ে যায়।
বিষয়টি জানতে পেরে এলাকার বাসিন্দারা সালিশি সভার ব্যবস্থা করেন। সেখানে অপরাধীর শাস্তির ব্যাপারে সকলেই একমত হন। তার পরেই মেয়েটির বাবা এ দিন পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
সোমবার রাতে নারী-নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের হয়েছে বারাসতেও। পুরসভার চার নম্বর ওয়ার্ডের আক্রমপুর এলাকার বাসিন্দা, একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রী সোমবার বিকেল থেকেই নিখোঁজ ছিল। রাতে সে বাড়ি না-ফেরায় পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। পরে বারাসত থানায় অভিযোগ দায়ের করার তোড়জোড় শুরু হয়। এর মধ্যেই রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ খবর আসে, ওই এলাকায় রাস্তার পাশে চার দিক খোলা একটি ছাউনির তলায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে ছাত্রীটি। পরিবারের লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে মেয়েটিকে শনাক্ত করেন। জ্ঞান না-ফেরায় মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া হয় বারাসত হাসপাতালে। রাতেই বারাসত থানায় অভিযোগ দায়ের করে তার পরিবার। হাসপাতাল সূত্রের খবর, মঙ্গলবার সকালে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় কিশোরীর। উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, “বারাসতের ঘটনায় হাসান ও ফারুক নামে দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে।”
ওই কিশোরী এবং তার পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন, ঠান্ডা পানীয়ের সঙ্গে মদ মিশিয়ে মেয়েটিকে অচৈতন্য করা হয়েছিল। পুলিশের দাবি, ধৃতেরা জানায়, তারা ওই কিশোরীর বন্ধু। এখনও ছাত্রীটির ডাক্তারি পরীক্ষা হয়নি।
কেন?
পুলিশের বক্তব্য, মেয়েটি ধর্ষণ বা নিগ্রহের অভিযোগ করেনি বলেই তার ডাক্তারি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়নি। কিশোরীর বাবা এ দিন প্রশ্ন তুলেছেন, কোনও উদ্দেশ্যই যদি না-থাকবে, অভিযুক্তেরা তাঁর মেয়েকে মদ খাইয়ে এ ভাবে ফেলে রেখে গেল কেন?
জেলায় নারী-নিগ্রহ রুখতে সম্প্রতি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবের নির্দেশে পুলিশ একটি ‘পাইলট প্রজেক্ট’ চালু করেছে। প্রতিটি থানার অফিসারদেরও এ ব্যাপারে তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনের উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে নারী-নির্যাতন রুখতে এ দিনই আট জন করে মহিলাকে নিয়ে জেলায় দু’টি কমিটি গড়েছে তৃণমূল। যেখানে নারী-নির্যাতনের ঘটনা ঘটবে, সেখানেই নির্যাতিতাদের দেখভাল করবে ওই কমিটি।
জেলায় একের পর এক ঘটনা নিয়ে এ দিন মধ্যমগ্রামে তৃণমূলের কার্যালয়ে বৈঠক করেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু, খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, আইন ও বিচার মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, সৌগত রায়-সহ উত্তর ২৪ পরগনার সাংসদ, বিধায়ক, পুরসভার চেয়ারম্যান, সব পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা। ঠিক হয়, ২৪ জানুয়ারি মধ্যমগ্রামের নজরুল মঞ্চ এবং ২৭ তারিখে বারাসত বিদ্যাসাগর মঞ্চে মহিলাদের বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেওয়া হবে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, “নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জেলায় সচেতনতা শিবির ও ট্যাবলো তৈরি করে প্রচার চালানো হবে।” |