নেশা ছাড়াতে আবাসিক পুনর্বাসন হোমে (রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার) রাখা হয়েছিল এক প্রৌঢ়কে। সোমবার রাতে বারাসত হাসপাতালের সামনে তাঁর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। অসংখ্য কালশিটে ও পোড়া দাগ ছিল গায়ে-পিঠে। অভিযোগ, হোমের কর্মীরাই তাঁকে পিটিয়ে মেরেছে। হোমের সুপারভাইজার-সহ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এ দিন সকালে হোম ছেড়ে পালান বাকি জনা কুড়ি আবাসিক। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, অকথ্য অত্যাচারের কথা জানিয়ে গিয়েছেন তাঁরাও।
দেবশেখর।
ছবি: শান্তনু হালদার।
|
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, গত বছর অগস্ট মাসে হাবরার বয়রাঘাটায় ‘উত্তরায়ণ’ নামে ওই পুনর্বাসন হোমে ভর্তি হন দমদম ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দা দেবশেখর চট্টোপাধ্যায় (৫১)। তাঁর পারিবারিক সূত্রের খবর, মদের নেশা ছাড়াতেই চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল দেবশেখরবাবুর। কাজ করতেন রেলে। কিন্তু আসক্তির জন্য চাকরিতেও নানা সমস্যা হয়।
২০১১ সালে বাধ্যতামূলক অবসর নেন। নিজেই হোমে থেকে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসা, থাকা-খাওয়া বাবদ উত্তরায়ণ কর্তৃপক্ষকে মাসে ৩ হাজার টাকা করে দিতেন দেবশেখরবাবুর পরিবার। বুধবার দুপুরে হাবরা থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন তাঁর বাড়ির লোকজন। এ দিনই বারাসত থেকে গ্রেফতার করা হয় হোমের সুপারভাইজার লিটন দাস ও হিসেবরক্ষক অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় জানান, লিটনের নামেই খুনের অভিযোগ দায়ের হয়েছিল থানায়। পুলিশের অনুমান, মারধরের জেরে অসুস্থ হয়ে পড়ায় দেবশেখরবাবুকে আনা হয়েছিল হাসপাতালে। |
সেখানে ছিল অর্ক নিজে। কিন্তু তত ক্ষণে মারা গিয়েছেন ওই ব্যক্তি। বিপদ বুঝে সরে পড়ে হোমের লোকজন। বছর চারেক ধরে ওই এলাকায় আছে হোমটি। দোতলা ওই হোম চালানোর জন্য আলাদা কোনও অনুমতি ছিল না বলেই প্রাথমিক ভাবে জানতে পেরেছে পুলিশ।
দেবশেখরের মেয়ে সপ্তমী জানান, সোমবার রাতে তাঁদের এক প্রতিবেশীর মোবাইলে ফোন আসে। নিজেকে হোমের আধিকারিক সায়ন্তন বসুর স্ত্রী পরিচয় দিয়ে এক মহিলা জানান, দেবশেখরবাবু বারাসতের হাসপাতালে ভর্তি আছেন। খবর পেয়ে গভীর রাতে বারাসতে আসেন দেবশেখরবাবুর পরিবারের লোকজন। বারাসত জেলা হাসপাতালে গিয়ে মর্গে খোঁজ মেলে ওই প্রৌঢ়ের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ জরুরি বিভাগের সামনে থেকে দেবশেখরবাবুর দেহ মেলে। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে মর্গে ঠাঁই হয়েছিল দেবশেখরের। শনাক্তকরণের পরে তা পাঠানো হয়েছে ময়না-তদন্তে।
কিন্তু কেন মারধর করা হল দেবশেখরবাবুকে? পুলিশ এখনও তা নিয়ে অন্ধকারে। নীতিশ মণ্ডল নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, ভোরের দিকে এ দিন হোমে কোনও কর্মী ছিলেন না। আবাসিকেরা পালানোর সময়ে কারও ছিল খালি পা। শীতের সকালেও গায়ে গরম জামা ছিল না অনেকের। কোনও মতে প্রাণ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছেন বলে মনে হয়েছে তাঁদের দেখে। এলাকার লোকজনকে ওই আবাসিকেরা
জানিয়ে গিয়েছেন, অত্যাচার সহ্য করে আর থাকতে পারছেন না। কেউ কেউ জামা খুলে দেখিয়েছেন, গায়ে-পিঠে মারের দাগ। |
উত্তরায়ণের পাশেই থাকেন কনকলতা বসু। তিনি বলেন, “হোমের দরজা-জানলা প্রায় সব সময়েই বন্ধ থাকত। প্রায়ই চিৎকার শুনতাম। মনে হত মারধর করা হচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার খুব জোরে হিন্দি গান চালিয়ে দেওয়া হত। এখন মনে হচ্ছে, অত্যাচারের শব্দ যাতে বাইরে না আসে, তাই ওই ব্যবস্থা।” সোমবার দুপুর থেকে চেঁচামেচি আরও বেড়েছিল, জানান তিনি।
বাসিন্দারা কেউ কেউ জানালেন, হোমের দশা নিয়ে কথা হয়েছিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। উত্তর মিলেছিল, নেশা ছাড়াতে ভয় দেখানো হয়, মারধর করা হচ্ছে না। এ সব নিয়ে বেশি কৌতুহল না দেখাতেও বলেছিল কর্তৃপক্ষ। সপ্তমী এ দিন বলেন, “বাবা যে এই অবস্থায় আছে বুঝতে পারিনি। যখনই আমি বা মা দেখা করতে এসেছি, বাবার সঙ্গে হোমের কেউ না কেউ থাকত। আলাদা করে কথা বলার সুযোগ তেমন পাইনি।” যদিও গত ৪ জানুয়ারি যখন সপ্তমী ও তাঁর মা সুচিত্রা শেষবারের মতো দেখতে এসেছিলেন দেবশেখরবাবুকে, তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য একলা পাওয়া গিয়েছিল তাঁকে। সপ্তমীর কথায়, “বাবা বলেছিল, খুব মারধর করা হয় হোমে। বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছিল।”
মেয়ের আফশোস, “বাবা নেশার জন্য অনেক সময়ে মিথ্যে কথা বলত। আমরা ভেবেছিলাম, সে রকমই হয় তো বলছে। তাই গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু সে কথাটা বিশ্বাস করলে বাবাকে এ ভাবে অকালে হারাতে হত না।” নেশা ছাড়াতে কেন দরকার মারধরের? ইনস্টিটিউট অব সাইকিয়াট্রির প্রধান প্রদীপ সাহা বলেন, “কখনওই মারা চলবে না। নেশার দ্রব্য না পেলে নেশাসক্তরা অশান্ত হয়ে উঠতে পারেন। তাঁদের ওষুধ, ইঞ্জেকশন দিয়ে শান্ত করতে হয়। তাঁদের নিরস্ত করার প্রশিক্ষণ দরকার। কখনওই তাঁদের কোনও আঘাত করার কথা নয়, মারধর তো নয়ই।” যথাযথ অনুমোদন ছাড়াই নেশাসক্তদের ‘পুনর্বাসন কেন্দ্র’ গজিয়ে উঠছে বলেই এমন বিপত্তি হচ্ছে, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। |