মাওবাদী প্রশিক্ষণেই কেএলওর মাইন-হানার আশঙ্কা
সাইকেলে ঝুলিয়ে রাখা হরেক কিসিমের আইইডি (ইম্প্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণের ভয় তো আছেই। সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গে এ বার ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণেরও আশঙ্কা করছে পুলিশ।
গোয়েন্দাদের খবর, বড়ো জঙ্গিদের একটি গোষ্ঠী কেএলও জঙ্গিদের হাতে ধরে আইইডি তৈরি ও ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। গত বছর আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়িতে সেই প্রশিক্ষণের ‘সফল’ প্রয়োগও করেছে ওই জঙ্গিরা। কিন্তু গোয়েন্দারা সম্প্রতি জেনেছেন, কেএলও-র নাশকতার সম্ভাবনা আর শুধু আইইডি বিস্ফোরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ওই জঙ্গিরা আইইডি দিয়ে ল্যান্ডমাইন তৈরি, মাটিতে পোঁতা এবং বিস্ফোরণ ঘটাতেও শিখে গিয়েছে। এবং ল্যান্ডমাইন ব্যবহারে যারা বিশেষ দক্ষ, সেই মাওবাদীরাই তাদের ওই কৌশল শিখিয়েছে বলে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের একাংশের দাবি।
কেএলও-র তরফে দাবি করা হয়, মাওবাদীদের সঙ্গে তাদের আদর্শগত দূরত্ব তো আছেই। আছে আরও নানা ধরনের পার্থক্যও। সে-ক্ষেত্রে তারা মাওবাদীদের কাছ থেকে ল্যান্ডমাইন তৈরির কৌশল শিখবে কেন?
রাজ্য পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, • ভারতের মাওবাদীদের সঙ্গে না-হলেও নেপালের মাওবাদীদের সঙ্গে কেএলও-র ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। • মাওবাদীদের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের চুক্তির বিষয়টি ২০১০ সালের ডিসেম্বরে জানতে পারে পুলিশ। ওই পুলিশকর্তা বলেন, “মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজি ২০০৯-এর অক্টোবরে এবং ২০১১-র মার্চ-এপ্রিলে অসম-সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গিয়ে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।” তিনি জানান, ওই দু’দফায় কিষেণজির কাছ থেকে উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের একাংশ ল্যান্ডমাইন তৈরির প্রশিক্ষণ নেয়। তাদেরই কেউ কেউ পরে কেএলও-কে মায়ানমারের জঙ্গলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাই প্রত্যক্ষ ভাবে না-হলেও পরোক্ষে মাওবাদীদের কাছ থেকে ল্যান্ডমাইন তৈরি এবং ব্যবহারের প্রযুক্তি কেএলও-র হাতে পৌঁছে গিয়েছে।
২০০৯-এ কিষেণজির উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফরের কয়েক মাসের মধ্যে, ২০১০-এর ৩০ জুলাই অসমের গোয়ালপাড়া জেলায় বড়ো জঙ্গিরা ল্যান্ডমাইন দিয়ে সিআরপি-র একটি গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছিল। ওই ঘটনায় নিহত হন পাঁচ জওয়ান। কেএলও কী ভাবে ল্যান্ডমাইন ব্যবহার করতে পারে, আইবি বা গোয়েন্দা বিভাগ তা-ও কিছুটা আঁচ করতে পারছে। আইবি-র এক কর্তা জানান, জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা যে-ভাবে তার টেনে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটায়, তাতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাদের প্রভাব ও সমর্থন থাকা জরুরি। প্রভাব ও জনসমর্থনের বিচারে কেএলও এখনও সেই জায়গায় পৌঁছয়নি। “তাই তার ব্যবহার না-করে তারা টাইমার ডিভাইস দিয়ে বা প্রেশার বম্বের প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাইন ফাটাতে পারে,” আশঙ্কা প্রকাশ করেন ওই গোয়েন্দা-কর্তা।
যখন-তখন আইইডি এবং ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের আশঙ্কার আবহে উত্তরবঙ্গে নিজেরাও প্রস্তুত থাকতে চাইছে পুলিশ। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার অমিত জাভালগি সম্প্রতি রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে চিঠি লিখে আলিপুরদুয়ারে একটি ‘বম্ব ডিটেকশন ও ডিসপোজাল স্কোয়াড’ গড়ার আবেদন জানিয়েছেন। শিলিগুড়িতে সিআইডি-র এই ধরনের একটি ইউনিট থাকলেও সেখানকার বিশেষজ্ঞদের আলিপুরদুয়ার সদর বা কুমারগ্রাম, বারোবিশা, শামুকতলার মতো এলাকায় পৌঁছতে অনেক সময় লেগে যায়। শিলিগুড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার সদরের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। গত ২৯ অগস্ট আলিপুরদুয়ার চৌপথিতে সাইকেলে ঝোলানো আইইডি উদ্ধার করা হয়েছিল ভোর ৪টে নাগাদ। আর শিলিগুড়ি থেকে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল সেখানে পৌঁছয় সকাল ১০টা নাগাদ। সুরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াই ওই আইইডি নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা যান সিআইডি-র বম্ব স্কোয়াডের এক কনস্টেবল। আবার রবিবার ফালাকাটায় একটি ‘ডামি আইইডি’ থেকে আতঙ্ক ছড়ায় সকাল পৌনে ৮টায়। কিন্তু শিলিগুড়ির বম্ব স্কোয়াডের গোয়েন্দারা সেখানে পৌঁছন পাঁচ ঘণ্টা পরে।
রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ অফিসারের বক্তব্য, শিলিগুড়িতে থাকা সিআইডি-র ওই বম্ব স্কোয়াড দিয়ে জলপাইগুড়ি জেলার, বড়জোর ময়নাগুড়ির মতো এলাকার ঘটনা সামাল দেওয়া সম্ভব। কিন্তু কুমারগ্রাম, বারোবিশা, ফালাকাটার মতো অসম ঘেঁষা এলাকায় শিলিগুড়ি থেকে পৌঁছনোর আগেই আইইডি ফেটে যেতে পারে। বিশেষ করে সেই আইইডি যদি টাইমার ডিভাইস দিয়ে ফাটানো হয়। “তাই আলিপুরদুয়ার সদরে নতুন একটি বোমা নিষ্ক্রিয়কারী ইউনিট তৈরি হলে কোচবিহারের ঘটনাও কম সময়ে সামাল দেওয়া যাবে,” বলেন ওই পুলিশ অফিসার।
জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, রাজ্য পুলিশের ডিরেক্টরেট থেকে নীতিগত ভাবে তাদের প্রস্তাবে সায় দেওয়া হয়েছে। ডিজি প্রস্তাবটি পাঠিয়ে দিয়েছেন সিআইডি-র কাছে। কারণ, রাজ্য পুলিশের মধ্যে শুধু সিআইডি-তেই বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড রয়েছে। তবে সেই স্কোয়াডের সদস্য-সংখ্যা কাগজে-কলমে ১৪০ হলেও বাস্তবে আছেন মাত্র ৪৪ জন। বর্তমানে ভবানী ভবনের সদর দফতর ছাড়াও মেদিনীপুর, দুর্গাপুর, মালদহ ও শিলিগুড়িতে ওই স্কোয়াডের পাঁচটি ইউনিট রয়েছে। কিন্তু অনুমোদিত সংখ্যার তুলনায় অনেক কম লোকজন নিয়ে ওই সব ইউনিটের কাজকর্ম চালাতে সমস্যা হচ্ছে। তা হলে নতুন ইউনিট কী ভাবে গড়া সম্ভব, সে-কথা সিআইডি-র কর্তারা বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্য, নতুন ইউনিট গড়ার জন্য সরঞ্জাম কিনতে হবে এবং সেটাও সময়সাপেক্ষ।
সিআইডি-র এক কর্তার কথায়, “অন্যান্য শাখা থেকে প্রশিক্ষিতদের বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডে আনার চেষ্টা চলছে। যদি এখনই পুরোদস্তুর একটি নতুন ইউনিট না-ও গড়া যায়, সে-ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে আমরা শিলিগুড়ির ইউনিটেরই অর্ধেক লোককে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আলিপুরদুয়ারে একটি বর্ধিত শাখা তৈরি করব।” কিন্তু শিলিগুড়ির ওই ইউনিটেই আছেন মাত্র সাত জন। তাঁদের দেখতে হয় মালদহ ও দক্ষিণ দিনাজপুর বাদে উত্তরবঙ্গের বাকি চারটি জেলা। অথচ একটি আইইডি শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে ন্যূনতম তিন জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক প্রয়োজন।
লোকাভাবে সিআইডি-র বম্ব ডিটেকশন ও ডিসপোজাল ইউনিটগুলি ধুঁকছে। আর সেই সময়েই কেএলও-র দৌরাত্ম্যে উত্তরবঙ্গে তীব্র হচ্ছে আরও বড় আকারের আইইডি কিংবা ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণের আশঙ্কা।

এই সংক্রান্ত অন্য খবর...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.