একই পরিবারের তিন মহিলাকে খুনের কিনারা হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করল পুলিশ। শনিবার মুর্শিদাবাদের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “নিত্যানন্দ দাস নামে এক যুবক ওই তিন মহিলাকে খুন করেছে।” নিত্যানন্দের দাবি, সে ‘জ্যোতিষচর্চা’ করে। তাকে এ দিন পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের সামনে নিয়েও আসেন। তবে পুলিশ সুপারের সাংবাদিক সম্মেলন চলার সময়েই নিত্যানন্দ নিজের মুখের ঢাকা খুলে ফেলে চিৎকার করতে থাকে, “আমি নির্দোষ। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে। আমাকে আপনারা বাঁচান।”
পুলিশকর্মীদের তখন দেখা যায় নিত্যানন্দকে চেপে ধরতে। হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরেন কয়েকজন পুলিশকর্মী। এক পুলিশকর্মী তার চুল মুঠো করে ধরেন। তার পরে বেশ কয়েক জন পুলিশকর্মী নিত্যানন্দকে পাঁজাকোলা করে সাংবাদিক সম্মেলনের জায়গা থেকে বার করে নিয়ে যান। তাকে বহরমপুর থানায় রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের কাছে পুলিশ সুপার দাবি করেন, “আপনাদের দেখে নিত্যানন্দ নাটক করেছে। তিন জনকে খুন করার পরে সেই ফ্ল্যাটেই সারা রাত কাটিয়েছে নিত্যানন্দ।” |
গত সোমবার বহরমপুরের একটি ফ্ল্যাট থেকে মধ্য চল্লিশের বিজয়া বসু, বিজয়াদেবীর পিসি বৃদ্ধা প্রভা দাস এবং বিজয়াদেবীর তরুণী কন্যা আত্রেয়ী বসুর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। কে কেন তাঁদের খুন করল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। এ দিন পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের বলেন, নিত্যানন্দের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন বিজয়াদেবীর স্বামী দেবাশিস বসুর কাছ থেকে। দেবাশিসবাবুকে বুধবার রাতে পুরী থেকে আটক করে পুলিশ। তিনিও এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশের দাবি, তিনি জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে জানিয়েছেন, বহরমপুর ছেড়ে চলে গেলেও স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। পুরী থেকে প্রতি মাসের ৬ তারিখে তিনি বাড়িতে টাকা পাঠাতেন। ফোনেও কথা হত। সেই সূত্রেই তিনি জানতে পারেন, বিজয়াদেবী সম্প্রতি বহরমপুরের এক জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলেন ভাগ্যগণনা করতে। সেই জ্যোতিষী বিজয়াদেবীকে জানান, তাঁর ও তাঁর মেয়ে আত্রেয়ীর ‘কালসর্প দোষ’ রয়েছে। সেই দোষ কাটাতে প্রায় ৫ হাজার টাকা খরচ হবে বলে তিনি বিজয়াদেবীকে বলেছিলেন।
দেবাশিসবাবু বলেন, “১ জানুয়ারি আমি ফোন করেছিলাম। তখন বিজয়া জানিয়েছিল, আর এক জ্যোতিষীর সঙ্গেও তার যোগাযোগ হয়েছে। সেই জ্যোতিষী কম টাকায় ওই দোষ খণ্ডন করিয়ে দেবে বলেছে।” পুলিশ সুপার জানান, দেবাশিসবাবুর কাছ থেকে সে খবর পাওয়ার পরে তাঁরা বহরমপুরের জ্যোতিষীদের উপরে নজরদারি শুরু করেন। তখনই জানা যায়, নিত্যানন্দ নামে এই জ্যোতিষীর সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিলেন বিজয়াদেবী। নিত্যানন্দ নিজের পরিচয় দিত ‘নিত্যানন্দ ভারতী (স্বর্ণপদক প্রাপ্ত)’ বলে। বহরমপুরের কাদাইয়ে একটি হোটেলে নিত্যানন্দ নিয়মিত ‘কোষ্ঠী বিচার’ করেন। সেই হোটেলের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরায় তোলা নিত্যানন্দ এবং সকন্যা বিজয়াদেবীর ছবি দেখেছে পুলিশ। এরপরেই খোঁজ করতে গিয়ে পুলিশ দেখে, ঘটনার পরদিন থেকে নিত্যানন্দ নিখোঁজ। তখনই সন্দেহ দৃঢ় হয়।
পুলিশের দাবি, নিত্যানন্দ তার দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, নিত্যানন্দ জেরার মুখে বলেছে, চুরির উদ্দেশ্যেই ফ্ল্যাটে ঢুকে ‘তন্ত্রসাধনা’ করবে বলে বিজয়াদেবীকে সে লোভ দেখিয়েছিল। তবে খুন করতে চায়নি। তা হলে কী করে মারা গেলেন ওই তিন মহিলা?
পুলিশের দাবি, নিত্যানন্দ কবুল করেছে, সে দিন সন্ধ্যায় বিজয়াদেবীকে সে শহরের জগন্নাথ ঘাটে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ‘তন্ত্রসাধনা’র নামে তিনটি সরা-তে চাল-কলা-দুধ-সন্দেশ মেখেছিল। পুলিশের দাবি, নিত্যানন্দ স্বীকার করেছে, সেই খাবারেই সে তখন রানাঘাট থেকে কিনে আনা ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছিল। একটি সরা-র খাবার সেখানেই বিজয়াদেবীকে খাইয়ে দিয়েছিল সে। বাকি দু’টি সরা-র খাবার সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটে ঢুকে খাওয়ানো হয়েছিল প্রভাদেবী ও আত্রেয়ীকে। রাত সামান্য বাড়তে তিন জনেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তাঁদের ওই অবস্থায় দেখে নিত্যানন্দ ভেবেছিল, এ বার অনায়াসে বাড়ির জিনিসপত্র চুরি করে নেওয়া যাবে। আলমারিও খুলে ফেলেছিল সে। কিন্তু বিজয়াদেবীর হুঁশ ফিরে আসে। বিজয়াদেবী বাথরুমে ঢুকে চিৎকার করতেও গিয়েছিলেন। পুলিশের দাবি, নিত্যানন্দ জেরায় কবুল করেছে, সে সময়ে বিজয়াদেবীকে থামাতে সে তাঁর মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়। তাতেই বাথরুমে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়ে। তবে তারপরেও বিজয়াদেবী সব বুঝে গিয়েছেন ভেবে, তাঁকে শেষ পর্যন্ত গলা টিপেই খুন করে নিত্যানন্দ।
ততক্ষণে হুঁশ ফিরে আসে বাকি দু’জনেরও। পুলিশের দাবি, তাই আর কোনও ঝুঁকি নিতে না চেয়ে সেই দু’জনকেও একই ভাবে খুন করে নিত্যানন্দ। পুলিশ জানিয়েছে, নিত্যানন্দ জেরায় বলেছে, তদন্ত ভুল পথে চালিত করতেই বিজয়াদেবীকে অর্ধনগ্ন ও আত্রেয়ীকে নগ্ন করে ফেলে সে। তারপরে পালাতে গিয়ে সে দেখে, আবাসনের সদর দরজা বন্ধ। তখন ওই ফ্ল্যাটেই সে ফিরে আসে। সারা রাত বাধ্য হয়ে সেখানেই কাটায়। পরের দিন সকালে নিত্যানন্দ বিজয়াদেবীর সোনার হার ও বালা নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে পালায়। সারগাছির একটি দোকানে বার, বালা বিক্রি করে সতেরো হাজার টাকা পায়। সেই টাকা নিয়ে সে মালদহ চলে যায়। সেখানেই ওই বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া চারটি মোবাইল সিম কার্ড খুলে ফেলে দেয়। তবে বিজয়াদেবীর ফোনটির সিম কার্ড নিজের সঙ্গেই রেখেছিল। পুলিশ তা উদ্ধার করেছে। নিত্যানন্দ মালদহ থেকে কলকাতাও গিয়েছিল। সেখান থেকে যায় শিলিগুড়ি। শুক্রবার রাতে শিলিগুড়ির একটি হোটেল থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ দিন সকালে তাকে বহরমপুরে নিয়ে আসে পুলিশ। সন্ধ্যায় নিত্যানন্দকে সঙ্গে করে ওই ফ্ল্যাটে গিয়েছিল পুলিশ।
ওই আবাসনের বাসিন্দারা এই ঘটনায় হতবাক। বিজয়াদেবীর প্রতিবেশী অরিজিৎ ঘোষাল বলেন, “পাশের ফ্ল্যাটে সে দিন এত কিছু হয়ে গেল, কিছুই টের পাইনি। জ্যোতিষ সংক্রান্ত খোঁজ খবর যে বিজয়াদেবীরা করছিলেন, তা-ও জানতাম না।” চন্দ্রাণী হাজরা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিজয়াদেবীর মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এই লোকটি যে ভাবে খুন করেছে, তা কিছুতেই মানা যায় না। এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।”
পুলিশ জানিয়েছে, নিত্যানন্দের আদি বাড়ি রেজিনগর থানার মাঙনপাড়া গ্রামে। বাবা নিমাই দাস সোদপুরের একটি হাইস্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক ছিলেন। কয়েক বছর আগে অবসর নেওয়ার পরে তিনি সস্ত্রীক বহরমপুর শহরে সুতির মাঠে ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। নিত্যানন্দ ওরফে নিতাই ছাত্র হিসাবে যথেষ্ট মেধাবী ছিল। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল থেকে ১৯৯৫ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার-সহ স্টার পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করে সে। বিজ্ঞানের ছাত্র নিত্যানন্দ ১৯৯৭ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু পুলিশ জানিয়েছে, তারপরে সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। ২০০০ সালে সিআরপিএফ-এ চাকরি নেয়। ২০০৬ সালে সেই চাকরি সে ছেড়ে দেয়।
বছর দশেক আগে তার প্রথমবার বিয়ে হয়েছিল। সেই বিয়ে অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। বছর আটেক আগে দ্বিতীয় বার বিয়ে করে সে। তার সেই স্ত্রীর নাম মানতাদেবী। বছর সাতেকের একটি ছেলেও রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছিল।
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পরে বহরমপুর শহর লাগোয়া বিভিন্ন এলাকায় সে সস্ত্রীক ভাড়া থাকত। ২০১৩ সালের ১৬ মে সে বহরমপুরের গা ঘেঁষা পাকুড়িয়া এলাকায় সুধাংশু দাশগুপ্ত ওরফে সন্তোষবাবুর বাড়িতে ভাড়া নেয়। সন্তোষবাবু বলেন, “বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় নিতাই বলেছিল, সে দোকানে ওষুধ সরবরাহ করে। দু’তিন মাস পরে বলে, সে নাকি জ্যোতিষী। মাঝে মাঝেই কয়েক দিনের জন্য বাড়ি থেকে চলে যেত।” সেই বাড়ি থেকে তাদের তুলে দেওয়া হয়। তখন কাছেই মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী পরমেশ্বর দাসের বাড়িতে নিত্যানন্দ ঘর ভাড়া নেয় গত ৮ ডিসেম্বর। এক কামরার ভাড়াবাড়িতে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে তারা থাকত। পরমেশ্বরবাবুর স্ত্রী প্রৌঢ়া শোভাদেবী বলেন, “সপ্তাহে দু’-এক দিন বাড়িতে থাকতেন তাঁরা। বাকি দিনগুলি স্বামী-স্ত্রীতে বাইরে চলে যেত। ছোট ছেলেটা তখন সুতির মাঠে তাঁর ঠাকুমা অঞ্জলিদেবীর কাছে থাকত। দিন পাঁচেক আগে তারা স্বামী-স্ত্রীতে বাইরে চলে যায়। সেই দিন থেকে শনিবার পর্যন্ত অঞ্জলিদেবী তাঁর নাতির সঙ্গে আমাদের ভাড়া দেওয়া বাড়িতেই ছিলেন।” |