ধর্ম হিজাবকে একটা বাঁধন হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আঠারো বছরের
মায়ম মাহমুদ সেই হিজাব পরেই তার স্বাধীনতা বুঝে নিচ্ছে। লিখছেন
সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়।
|
পাড়া প্রতিবেশী তো অবাক। কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছে না। এমন ইয়ো ইয়ো র্যাপ-গান কোথা থেকে ধেয়ে আসছে বেগে? তা-ও আবার মেয়ের গলায়? অনেক মাথা চুলকে নতিজা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে, পাড়ায় বেয়াড়া কোনও মেয়েকে তো তারা দেখেনি। পাড়ার কোনও মেয়ের চালচলন তেমন ব্যাঁকাট্যারা নয়, উচ্ছৃঙ্খলও বলা যাবে না কাউকে। তা হলে এমন ঝিংচ্যাক গান কে গাইছে?
গাইছে মায়ম মাহমুদ। আঠারো বছর বয়স। মাথায় হিজাব, মুখে পরিমাণ মতো হায়া-শরম। চালচলন ঠিকঠাক। কায়রোর মেয়ে। অর্থনীতি নিয়ে কলেজে পড়ছে।
মেয়ে র্যাপ গান গায়। বলেন কী? আজ্ঞে। শুধু গাইছে না। টেলিভিশনে পারফর্ম করছে। রিয়ালিটি শো-এ নজর কেড়েছে। ফেসবুক পেজ-এ মেসেজ-এর বন্যা। সে এখন বিশ্বখ্যাত। ‘আরব’স গট ট্যালেন্ট’ টিভি প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছেছিল। জিততে পারেনি। কিন্তু আসলে সে জয়ী। মিশর আর আরব দুনিয়ার হাজার হাজার মেয়ের কাছে, যারা নিজেদের অসহায়তা নিয়ে কুঁচকে গুটিয়ে আছে সমাজের চোখরাঙানিতে। তাদের প্রতিনিধি মায়ম। তাদের গলার জোর মায়ম। |
পথটা খুব মসৃণ ছিল না। মা-বাবা সংগীতে আগ্রহী, তাঁরা মায়মকে গাইতে বারণ করেননি। তবে বছর দশেক বয়সে মেয়ে যখন র্যাপ গাইতে শুরু করল, তাঁরাও আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু মায়ম তাঁদের বোঝাতে পেরেছে তার মনের কথা, তার প্যাশনের কথা। সে নিজের গান নিজে লেখে, নিজেই গায়। আর যখন গায় তখন পাড়া-প্রতিবেশী এমন জোরালো গলা শুনে চমকে ওঠে। ভাল লাগুক বা না লাগুক, অস্বীকার করতে পারে না।
মায়মের গানের কথা না-পসন্দ ইসলাম দুনিয়ার বিধাতাদের। মায়ম যে তাঁদেরই দোষী ঠাওরাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সমীক্ষা বলছে, ইজিপ্ট-এ ৯৯.৩ শতাংশ মেয়ে যৌনহেনস্তার শিকার। কিন্তু মেয়েরা মুখ খুললেই তারা খারাপ, তাদের চরিত্র নিয়ে টানাটানি। তাই সব মেয়ের মুখেই খিল। সেই খিল খুলছে মায়ম। সে তার গানে বলছে মেয়েদের প্রতি ভয়ঙ্কর নির্যাতন, যৌনলাঞ্ছনার ভয়াবহ কাহিনি। আর সোজাসাপটা দোষ দিচ্ছে সেই পুরুষদের, যারা এমনটা করে। মায়ম বলছে, ইজিপ্টে তো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পড়া মানেই চরিত্রহীনা, স্বামীর থেকে স্ত্রী বড় মাইনের চাকরি করা মহাপাপ। তা হলেই ভেবে দেখুন, যে মেয়েটা অনেকগুলো ছেলের সঙ্গে একটা স্টুডিয়োর ভেতর গান রেকর্ডিং করে, তার চরিত্র বলে কি কিছু থাকে? আর তাই যে সব মেয়ে গানটা রেকর্ডিং করে ফেলে, তারা আবার গান রেকর্ডিংয়ের পরবর্তী ধাপে কারও সাহায্য পায় না, কারণ খারাপ চরিত্রের মেয়ের সঙ্গে বসে তো আর গান মাস্টারিং করা যায় না।
তো কী? মায়ম কি আর থামবে? মোটেই না। এক তো তার গান গাইতে ভাল লাগে, আর মেয়েদের প্রতি অন্যায়ের একটা কোথাও তো বিচার চাই। অন্তত বিচারের দাবি চাই, প্রতিবাদ চাই, অনেক মেয়ের হয়ে একটা এত জোরদার আওয়াজ বানাতে হবে, যাতে বিধাতাদের কানের পর্দায় আর মস্তিষ্কের ঝিল্লিতে গিয়ে নাড়া দেয়। মায়মকে অনেক মেয়ে বলেছে, ‘আমাদের তো সাহস নেই, তুমি আমাদের হয়ে এমন সব কথা বলছ, যা আমাদের মনের কথা। যে কথা প্রতিবাদ হয়ে ইসলামি দুনিয়ার মস্তিষ্কে আঘাত করতে পারবে।’
মায়মকে থামানোর চেষ্টা অনেক হবে। এখনই বলা হচ্ছে, তার চরিত্র ভাল নয়। এর পরে তো আরওই চেপে দেওয়ার চেষ্টা হবে। কিন্তু মায়ম থামবে না। সে মনে করে, যত ক্ষণ না মেয়েরা তাদের সমস্যা বলছে, যত ক্ষণ না তাদের প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে, অত্যাচার, নির্যাতন তত ক্ষণ কমবে না। তার মতে, ‘আমরাই সমস্যাটাকে বাড়িয়ে তুলছি চুপ করে থেকে।’ তার একটি র্যাপ গানে বলছে সে, ‘অনেকেই ভাবেন সারা শরীর আবৃত রাখ, তা হলে আর যৌন হেনস্তার শিকার হবে না। কিন্তু আমার শরীর আমার, শরীরে অধিকার একমাত্র আমার’। এমন গান গাওয়ার পর সমালোচনা আর দোষারোপ তো শুনতেই হবে।
মায়ম র্যা্প গান গায় ঠিকই, পাশ্চাত্যের প্রভাব তার মধ্যে আছে ঠিকই, কিন্তু সে নিজের ধর্মকে অস্বীকার করেছে এমনটা নয়। হিজাব পরেই সে গায়। আর আশেপাশের মানুষজন এতেই আরও বেবাক বনে যায়। মাথায় হিজাব পরে একটা মেয়ে এমন করে র্যাপ গান গাইতে পারে! কিন্তু এই পোশাকের জন্যেই তাকে আবার কাঠগড়ায় তোলাও হচ্ছে হিজাবের মতো পবিত্র পোশাক, যা কিনা লজ্জা-শরম-নম্রতার প্রতীক, সেই হিজাব পরে কেউ র্যাপ গান গাইতে পারে? মায়মের সাফ জবাব, ‘হিজাব আমার পছন্দের পোশাক। তা পরে র্যাপ গাইতে পারব না, কে বলল? স্বাধীনতার জন্য যা কিছু করতে চাই, হিজাব পরেই আমি তা করব। ধর্ম কখনও কোনও কাজের অন্তরায় হতে পারে না। ধর্মকে আমরাই নিজেদের মতো করে ব্যবহার করি।’
মায়মের সাহসকে কুর্নিশ করি। ধর্ম হিজাবকে একটা বাঁধন হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। আর মায়াম সেই বাঁধনের উদ্দেশ্যকেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে। হিজাব পরেই সে তার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। সব মেয়েই যদি এমনটা করতে পারে, তা হলে হয়তো কে বলতে পারে, হিজাব নিতান্তই একটা পোশাকে পরিণত হবে। র্যাপারদের পোশাকের একটা অঙ্গ, কিংবা রোদ্দুরে বেরোলে চুল নষ্ট না হওয়ার একটা উপায়।
মায়ম মিশরের প্রথম মহিলা র্যাপার নয়, হিজাব পরা প্রথম গায়িকাও নয়। কিন্তু মায়ম আরব দুনিয়ার চুপ করিয়ে দেওয়া মেয়েদের সশব্দ প্রতিবাদ। ন্যায়যোদ্ধা। |